দেশে-বিদেশে বহুল আলোচিত-সমালোচিত সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর এলাকার সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় গতকাল বুধবার তদন্ত কমিটির গনশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা পর্যটন কেন্দ্র ও রেলওয়ে বাংকার এলাকায় অবৈধ পাথর উত্তোলনের ঘটনায় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভয়াবহ ক্ষতির প্রেক্ষিতে এই গণশুনানি আয়োজন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। গতকাল সকালে সিলেট সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত এই গণশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) জাহেদা পারভীনসহ কমিটির অন্যান্য সদস্যরাও। গণশুনানিতে অংশ নেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এদিকে সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় ৫০ জনকে খুজছে সিআইডি। তদন্তের পাশাপাশি অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।
গনশুনানিতে অংশ নেন পরিবেশ অধিদপ্তর, ট্রাক পরিবহন মালিক সমিতি, পাথর ব্যবসায়ী সমিতি, পরিবেশবাদী সংগঠন ও সাংবাদিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা, তথ্য ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করেন। তদন্ত কমিটি গত মঙ্গলবার থেকে সরেজমিন তদন্ত শুরু করে, যার অংশ হিসেবে তারা সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শনও করেছেন। গত ২০ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে এই কমিটি গঠিত হয়।
এর আগেই সাদাপাথর লুটপাট সংক্রান্ত একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের অনুসন্ধানে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীসহ ৫২ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি)-সহ প্রশাসনের অনেককেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। দুদকের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন গঠিত আরেকটি তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদন দিয়েছে, যেখানে শতাধিক ব্যক্তির জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তবে তাদের নাম তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা হয়নি। পাথর লুটপাটে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, দায় এড়াতে বিভিন্ন মহলের একে অপরকে দোষারোপ ও দীর্ঘদিন ধরে চলমান অনিয়মের বিষয়টি গণশুনানিতে বারবার উঠে আসে। তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সকল তথ্য ও বক্তব্য যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্রুত সময়ের মধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেওয়া হবে।
৫০ জনের খোঁজে সিআইডি : এদিকে সিলেটের সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনায় প্রায় ৫০ জনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তদন্তে নেমেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতায় এ অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার সিআইডির (ঢাকা) বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খানের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সিলেটের সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনায় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে সিআইডি। সিলেটের 'সাদা পাথর” লুটপাটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য এবং ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত একাধিক খবরের প্রেক্ষিতে ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট, সিআইডি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ মোতাবেক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে। বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক উক্ত লুটপাটের ঘটনায় প্রায় ৫০ জন ব্যক্তির প্রাথমিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর সিআইডি এ অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
পরিবেশগত অপরাধ সংঘটনপূর্বক আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অভিপ্রায়ে সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনায় যে সকল ব্যক্তিবর্গ ও সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ মোতাবেক যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এদিকে, সাদা পাথর থেকে লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ পাথর উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সিলেটের নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলম জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ২৬ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার হয়েছে, এর মধ্যে ১১ লাখ ঘনফুট প্রতিস্থাপনও করা হয়েছে। অন্তত ৫০০ শ্রমিক, ৪০০ নৌকা ও ৩০০ ট্রাকের সমন্বয়ে প্রতিদিন কাজ চলছে। তার মতে, প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ হতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। পাথরের সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জেলা প্রশাসক বলেন, "নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৩০ শতাংশ এখনো উদ্ধার সম্ভব হয়নি, কারণ অনেক পাথর ভেঙে ফেলা হয়েছে।" এছাড়া, তিনি জানান, তিন দিনের আল্টিমেটাম শেষ হয়েছে গত মঙ্গলবার। গতকাল বুধবার থেকে যার কাছে লুট হওয়া পাথর পাওয়া যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কারো কাছে পাথর পাওয়া যায়নি। পরিবেশবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিস্থাপন কাজ যতটা সম্ভব প্রকৃতির কাছাকাছি রূপে সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।