DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

গ্রাম-গঞ্জ-শহর

সুন্দরবনে দস্যু আতঙ্কে চর ছাড়ছেন জেলেরা

দস্যুমুক্ত ঘোষণার প্রায় সাত বছর পর ফের একাধিক দস্যু বাহিনীর আবির্ভাব ঘটেছে সুন্দরবনে। চালু হয়েছে কার্ডের (টোকেন) মাধ্যমে চাঁদা আদায়ের সেই পুরনো প্রথা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে দস্যুমুক্ত হয় সুন্দরবন। সেই থেকে সাগর ও বনে শূণ্যের কোটায় নেমে আসে দস্যুতা।

খুলনা ব্যুরো
Printed Edition
Default Image - DS

দস্যুমুক্ত ঘোষণার প্রায় সাত বছর পর ফের একাধিক দস্যু বাহিনীর আবির্ভাব ঘটেছে সুন্দরবনে। চালু হয়েছে কার্ডের (টোকেন) মাধ্যমে চাঁদা আদায়ের সেই পুরনো প্রথা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে দস্যুমুক্ত হয় সুন্দরবন। সেই থেকে সাগর ও বনে শূণ্যের কোটায় নেমে আসে দস্যুতা। বিলুপ্ত হয় যুগ যুগ ধরে চলা জেলে অপহরণ ও নির্যাতনের পাশাপাশি দস্যুদের সেই কার্ড প্রথার। বন্ধ হয়ে যায় অস্ত্রের ঝংকার। সেই থেকে নির্বিঘ্নে মৎস্য অবতরণ করে আসছিলেন জেলেরা। কিন্তু হঠাৎ করে আবার দস্যুদের উত্থানে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালি ও পেশাজীবীরা। ২৬ জানুয়ারি পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরের আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর ১৫ জেলেকে অপহরণ করে দয়াল বাহিনী। এ সময় সংঘবদ্ধ জেলেরা তিন দস্যুকে ধরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয় দস্যুরা। শুরু হয় জিম্মি এবং জেলেদের ওপর নির্যাতন।

প্রত্যেক জেলের মুক্তিপণ দাবি করা হয় তিন লাখ টাকা করে। শেষ পর্যন্ত জনপ্রতি দুই লাখ ৮৫ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে ২০-২৫ দিন পর জিম্মিদশা থেকে ছাড়া পান ১৫ জেলে। দস্যুদের অব্যাহত হুমকিতে এরই মধ্যে শুঁটকি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন বহু ব্যবসায়ী। অপহরণের ভয়ে শত শত জেলে-শ্রমিক শুঁটকিপল্লী ছেড়ে বাড়িতে চলে গেছেন।

নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, জেলে অপহরণ ও দস্যু আটকের ঘটনার পর থেকে আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর ব্যবসায়ীদের ওপর হুলিয়া জারি করে দয়াল বাহিনীর প্রধান মজনু ডাকাত। সাগরে মাছ ধরতে হলে তাদের কাছ থেকে কার্ড নিতে হবে। এ জন্য ট্রলার প্রতি ধার্য করা চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। আলোরকোল শুঁটকিপল্লীতে সাগরে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত ট্রলারের সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। এর মধ্যে গত এক মাসে তিন শতাধিক ট্রলারে কার্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। দস্যুদের দেওয়া বিকাশ ও নগদ নম্বরে এই চাঁদার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে তাদের।

ভুক্তভোগীরা আরো জানান, দর-কষাকষির পর ট্রলারপ্রতি ২৫ হাজার টাকা চাঁদা নির্ধারণ করেছে দস্যুরা। এতে দুই সহস্রাধিক ট্রলার থেকে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের লক্ষ্য (টার্গেট) রয়েছে দস্যুদের। দ্রুত চাঁদা পরিশোধ করে কার্ড বা টোকেন নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। দস্যুরা মোবাইল ফোনে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে বলেছে, ‘কার্ড বিহীন কোনো ট্রলার পেলে জেলেদের কেটে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়াসহ ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়া হবে।’ এর পর থেকেই আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মহাজন ও জেলেরা।

আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর চাকলা বেল্টের সভাপতি আব্দুর রউফ জানান, গত ২৬ জানুয়ারি জেলে অপহরণকালে তার ট্রলারের জেলেরা তিন দস্যুকে আটক করেছিল। এতে ক্ষীপ্ত হয়ে দস্যুরা মোবাইল ফোনে তাকে হুমকি দিতে থাকে। তার ট্রলার ও জেলেদের সাগরে পেলে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। এর পর থেকে তার জেলেরা সাগরে নামতে পারছেন না। ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে তার। তার ছয়জন জেলে ভয়ে পালিয়ে গেছেন। এমনকি তিনি নিরাপত্তাহীনতায় শুঁটকিপল্লী ছেড়ে তার নিজ গ্রামে অবস্থান করছেন।

ব্যবসায়ী রউফ মেম্বার আরো জানান, তার সমিতির সদস্য শুঁটকি ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ শেখ, নাছির বিশ্বাসসহ বহু ব্যবসায়ী দস্যুদের হুমকিতে ব্যবসা গুটিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। শুঁটকি ব্যবসায়ী পঙ্কজ বিশ্বাস জানান, শুঁটকি মওসুম এখন শেষের পথে। নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয় মওসুম। চলবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। শেষ মুহূর্তে এসে দস্যু আতঙ্ক জেঁকে বসেছে আলোরকোলে। অপহরণের ভয়ে গভীর সাগরে যেতে পারছেন না জেলেরা। ভয়ে বহু ব্যবসায়ী ও জেলে চর ছেড়ে চলে গেছেন।

শরণখোলা সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন জানান, একসময় বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে হলে নিয়মিত চাঁদা দিতে হতো জল ও বনদস্যুদের। এ জন্য প্রত্যেক মহাজনকে মওসুমের শুরুতেই ধার্যকৃত চাঁদা পরিশোধ করে দস্যুবাহিনীর কাছ থেকে তাদের নির্ধারিত টোকেন সংগ্রহ করতে হতো। টোকেন থাকলে নিরাপদে মাছ ধরা যেত সাগর ও বনে। টোকেনবিহীন কোনো ট্রলার বা নৌকা পেলেই অপহরণ ও নির্যাতন করা হতো ওই সব ট্রলারে থাকা জেলেদের। এর পর আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। দীর্ঘ বছর পর আবারও দস্যুদের উত্থান ও টোকেন প্রথা চালু হওয়ায় নতুন করে আতঙ্ক বিরাজ করছে ইলিশ আহরণের জেলে ও মহাজনদের মধ্যে।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরেস্টার মো. আসাদুজ্জামান জানান, চরের জেলে-মহাজনরা দস্যু আতঙ্কে আছেন। বহু মহাজন ও জেলে চর ছেড়ে চলে গেছেন। নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করে দস্যুদের কাছ থেকে টোকেন সংগ্রহ করে সাগরে যেতে হচ্ছে জেলেদের।