ট্যাক্স জিডিপির অনুপাত উন্নত করা হোক : চিটাগং চেম্বার প্রশাসক
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব করতে ১১৪টি প্রস্তাবনা দিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। যার মধ্যে আছে আয়কর বিষয়ক ১৯টি, ভ্যাট বিষয়ক ৪০টি ও শুল্ক বিষয়ক ৫৫টি প্রস্তাবনা। গতকাল বৃহস্পতিবার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কনফারেন্স হলে আয়োজিত প্রাক-বাজেট মতবিনিময় সভায় এই প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের পক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের কাছে তিনি লিখিত প্রস্তাবনা তুলে দেন চিটাগং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা।
সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে আমরা সরাসরি জড়িত না। আমরা বুঝতে পেরেছি বন্ডে সমস্যা আছে। তাই আমরা বন্ড পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় করতে চাচ্ছি। কিন্তু অনেকে অসুবিধার কথা বলে এতে সমর্থন করছে না। সার্টিফিকেট, লাইসেন্স, পারমিট এসব অনলাইনে করার প্রক্রিয়া চলছে। ভ্যাটের অডিট ও ভ্যাটের রিটার্ন সহজ করার জন্য কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স বাড়াতে না পারলে দেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়া যাবে না। আপনারা যৌক্তিক দাবি দিয়েছেন। বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করা হবে। বাজেট প্রণয়নে এ সুপারিশ দেওয়া হবে। তবে আমরা এখন রাজস্ব আহরণের বিষয়ে জোর দিচ্ছি। এরমধ্যে কর ফাঁকির বিষয়টি আমাদের প্রধান প্রায়োরিটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবারের বাজেট হবে ব্যবসাবান্ধব বাজেট। বাজেটকে জনবান্ধব করতে ব্যবসায়ীসহ সকলের মতামত নেয়া হচ্ছে। যার প্রতিফলন পাওয়া যাবে বাজেটে। আগামী বাজেটে ঘাটতি থাকবে কিন্তু যাতে মূল্যস্ফীতি না হয় সেই দিকেও লক্ষ্য রাখা হবে। আর রাজস্ব আদায়ে যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হবে করহারও। ’
“গত অর্থ বছরে ৪৫ লাখ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করে। যার মধ্যে ৩০ লাখ করদাতা শূন্য রিটার্নধারী। বাকী ১৫ লাখ কারদাতা থেকে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এত কম সংখ্যক লোকের থেকে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। এনবিআর জরিপ করে যারা রিটার্ন দিচ্ছে না তাদের নোটিশ দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে তাদের ব্যাংক হিসেব তলব করা হবে।”
“বাংলাদেশের ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও খুবই কম। তাই করহার বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন-মার্কিন শুল্ক আরোপের ফলে দেশের পোশাকখাত যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সরকার আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা যাতে এনবিআর অফিসে ঘুরতে না হয় সেজন্য সবকিছু অটোমেশন করা হচ্ছে। এখন সিঙ্গেল উইন্ডোর মাধ্যমে এক লাখ ৬০ হাজার সার্টিফিকেট অনলাইনে প্রদান করা হয়েছে।”Ñ বলেন তিনি।
তিনি জানান, ‘ভ্যাট এবং বন্ড সুবিধা নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। আমরা বন্ড সুবিধা অটোমেশনের আওতায় আনতে কাজ করছি। এছাড়া আয়করের মতো ভ্যাটও যেন ঘরে বসে দেয়া যায় সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। তিনি আগামী বাজেটে ভ্যাট হার যৌক্তিকীকরণ এবং ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ট্যাক্স রেট কমানো, ট্যাক্সনেট বৃদ্ধি ও রিফান্ড ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হবে’।
চিটাগাং চেম্বার প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা বলেন, ‘নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস এর থ্রি জিরো থিওরি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশও সত্যিকারের একটি কল্যাণমূলক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে, তবে, নতুন সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচিত হবে। এজন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে বিকল্প উপায় বের করতে হবে। আমদানি পর্যায়ে করহার পুনর্বিন্যাস, কিংবা দেশীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য নানাবিধ প্রণোদনার বিকল্প উপায় বের করতে হবে। ট্যাক্স সিস্টেমের সময়োপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে ট্যাক্স জিডিপি অনুপাতও কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নীত করার আহবান জানান।’
সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৪ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা সময়ের দাবী উল্লেখ করে পরবর্তী ধাপগুলো পুনর্বটন করার মাধ্যম আয়ের করদাতাদের মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ সহনীয় এবং ব্যক্তিগত ট্যাক্স লায়বিলিটি কমিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি করদাতাদের রিটার্নে উৎসাহিত করা গেলে করদাতার সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে উল্লেখ করেন মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, মেশিনারিজের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। রপ্তানি-আমদানি আরও সহজ করার লক্ষে এটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। শেয়ার বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে। শেয়ারের উপর ৪০শতাংশ এবং ডিভিডেন্ডের উপর ২৫ শতাংশ দিলে কী থাকে উদ্যোক্তাদের। তিনি এই করহার কমানো এবং প্রাইভেট কোম্পানীগুলোর করহার কমানোরও আহবান জানান।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি সরওয়ার জামাল নিজাম বলেন, ‘বাংলাদেশের এখনও ৫৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ভ্যাটকে সহনীয় পর্যায়ে এনে জনসাধারণের যাতে সুবিধা হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সরাসরি যেসব ট্যাক্স আছে সেগুলো কমিয়ে আনা হোক।’
বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘অডিটকে কত সহজভাবে করা যায়; সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এছাড়া চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ আলোচনা যাতে আমলে নেওয়া হয়। বিগত বছরগুলোতে আলোচনা হলেও তার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায়নি।’
চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বারের সভাপতি আবিদা সুলতানা বলেন, ‘দেশের এসএমই খাতের ভূমিকা রাখছে নারী উদ্যোক্তারা। বর্তমানে দেশের নারীরা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ব্যবসাক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন। বাজেটে তাদের দিকে বিশেষ নজর রাখা দরকার। ভ্যাট-ট্যাক্সের ক্ষেত্রেও তাদের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। তাই আগামী বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের এসএমই খাতে সুযোগ সুবিধার বাড়ানোর আহবান জানান তিনি।’
“এইচএস কোড জটিলতা নিরসন, ছোটখাট ও অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটির কারণে ২০০-৪০০শতাংশ কাস্টমস জরিমানা আরোপ না করা, আগাম করের ক্ষেত্রে দ্রুত রিফান্ড, অডিট সহজীকরণ, সর্বোচ্চ ভ্যাট হার সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসা, ভ্যাটের প্রথম আপীলের ক্ষেত্রেও দাবীকৃত করের উপর ২০শতাংশ টাকা জমা দেয়ার নিয়ম প্রত্যাহার করা এবং দেশীয় উৎপাদনমূখী শিল্পকে সুরক্ষা ও প্রণোদনা, চট্টগ্রাম কাস্টমস এর জনবল ও ল্যাব এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি, ডাবল ট্যাক্সেশন কমানো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অডিটের আওতার বাইরে রাখা এবং সেন্ট্রাল বন্ড সিস্টেম চালু করার প্রস্তাব উত্থাপন বক্তারা করেন।”
চিটাগং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশার সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন সিনিয়র সহ-সভাপতি এরশাদ উল্লাহ, প্রাক্তন সহ-সভাপতি বেলাল আহমেদ, চিটাগাং চেম্বারের সাবেক পরিচালক হাসানুজ্জামান চৌধুরী (জোসেফ) ও আমজাদ হোসেন চৌধুরী, পান রপ্তানিকারক এসোসিয়েশন এর সভাপতি মো. একরামুল করিম চৌধুরী, কক্সবাজার চেম্বার সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী (খোকা), রাঙ্গামাটি চেম্বার সভাপতি মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ মামুন, চট্টগ্রাম ট্যাক্সেস বার এসোসিয়েশন এর সভাপতি মো. আবু তাহের, চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক মো. শওকত আলী, চট্টগ্রাম ফ্রেশ ফ্রুটস ভেজিট্যাবলস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন এর সভাপতি মাহবুব রানা, বাংলাদেশ ফার্ণিচার শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মাকসুদুর রহমান, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সালেহ আহমেদ সুলেমান, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট এন্ড বিজনেসেস ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কামরুল হুদা, চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এক্সেসরিজ এসোসিয়েশন এর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, বিএসআরএম জিএম শেখর রঞ্জন কর ও সিটি কর্পোরেশন এর কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ শামীম প্রমূখ। সভায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম, চেম্বারের সাবেক পরিচালক কামাল মোস্তফা চৌধুরী ও জহিরুল ইসলাম চৌধুরী (আলমগীর), পার্ক শিপিং লাইন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী, টি.কে. গ্রুপের এডভাইজর জাফর আলম, লুব-রেফ’র এমডি মোহাম্মদ ইউসুফ, এইচআরসি’র সিনিয়র পরিচালক কাজী রুকুনউদ্দীন আহমেদ, খাগড়াছড়ি চেম্বার পরিচালক নজরুল ইসলাম, টেরীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান, বিকেএমইএ এর পরিচালক ফৌজুল ইমরান খান উপস্থিত ছিলেন।