মো. রফিকুল ইসলাম, শ্যামনগর, (সাতক্ষীরা) : সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শৈলখালি গ্রামের বাসিন্দা তিনি। নালার মতো বয়ে যাওয়া খালে কিছুক্ষণ আগেই মাছ শিকারের চেষ্টা করেছেন। যা পেয়েছেন তা নিয়ে হতাশ।

সাতক্ষীরার গ্রাম অঞ্চলে ভেদা নামে পরিচিত সুস্বাদু মাছটির প্রমিত নাম রয়না মাছ। এর আরেকটি জনপ্রিয় নাম হলো মেনি মাছ বা নন্দই। শুধু যে গ্রামের মৎস্য শিকারি আনিছুর আর নরেশ মন্ডল ভেদা মাছ বিলুপ্তির কথা বলছেন তেমন নয়, খোদ মৎস্য অধিদপ্তরও বলছে কৈ, শৈল, বোয়লসহ বেশ কয়েকটি মাছ বিলুপ্তির পথে। অথচ নদী ও জলাশয় প্রধান সাতক্ষীরা জেলা দেড় দশক আগেও কৈ, শিং মাছের প্রাচুর্য ছিল ঈর্ষণীয়।

কৈ, শৈল, ও চ্যাং মাছের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি দেশীয় প্রজাতির মাছ উদ্বেগজনকহারে হারিয়ে যাচ্ছে। এই মাছগুলোর বিষয়ে কোনো গবেষণা, তথ্য এমনকি পর্যবেক্ষণও নেই মৎস্য অধিদপ্তরের। তবে দপ্তরটি জানিয়েছে, সাতক্ষীরা জেলা থেকে প্রায় পাঁচটি প্রজাতের মাছ বিলুপ্তির পথে রয়েছে। মাছগুলো হচ্ছে- রয়না, সরপুটি, বাইম, তারা বাইম ও পাবদা শিং, কৈ, শৈল ও চ্যাং।

সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় বাজার, দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া বাজার, গাজিরহাট বাজার, কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা, কালিগঞ্জ সদর, নাজিমগঞ্জ, মৌতলা বাজার, শ্যামনগর উপজেলা সদর, নকীপুর, বংশীপুর, হরিনগর ও ভেটখালি বাজার পাইকারী মৎস অবতরণ কেন্দ্র। শ্যামনগর- কালিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে নদী, সাগর ও চাষের মাছে বাজার সয়লাব। দেশীয় প্রজাতির মাছ নেই বললেই চলে। এছাড়া আশাশুনি, দেবহাটা, উপজেলার কয়েকটি বাজারের মাছ ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করলে তারা জানিয়েছেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ বাজারে খুব কম উঠছে। এর প্রধান কারণ খাল, বিল, ডোবায় মাছ নেই।

কেন কমছে দেশীয় প্রজাতির মাছ

এক গবেষণায় বলছে, দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ২৫ শতাংশ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছ। নদী কমিশনের তথ্য মতে, দেশে মোট নদীর ১০০৮টি। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রবহমান নদী আছে ৯৩১টি। নাব্যতা হারানো নদীর সংখ্যা ৩০৮টি। রংপুর বিভাগে ৭১টি, রাজশাহী বিভাগে ১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি, সিলেট বিভাগে ১০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি এবং খুলনা বিভাগে ৮৭টি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার অল্প কিছু নদী এখন পর্যন্ত সচল থাকলেও এসব নদী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে মাছের প্রাচুর্য। খাল, জলাশয়, বিলে দেখা মিলছে না মাছের।

সাতক্ষীরা জেলার সহকারী অধ্যাপক ড. মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করায় দিনে দিনে দেশীয় প্রজাতির মাছ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। দুই দশক আগেও আমরা দেখেছে দক্ষিণাঞ্চলের নদী, নালায় দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। কিন্তু দুই দশকে এত বেশি কীটনাশক ব্যবহৃত হয়েছে ফসলের ক্ষেতে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছের জীববৈচিত্রে।

মৎস্য অধিদপ্তরের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই

মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ করতে সরকার ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর উল্লেখযোগ্য সফলতা থাকলেও সাতক্ষীরায় দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। পর্যায়ক্রমে এই মাছগুলো কমে যাচ্ছে। এর কারণ বিল, নদী, খাল, পুকুর, জলাশয় কমে যাচ্ছে। এতে দেশীয় প্রজাতির কৈ, শিং, মাগুর, রয়না, সরপুটি, পাবদা, শৌল, টাকি অর্থাৎ অতীতে যে মাছগুলো প্রিয় ছিল সেগুলো দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। এরমধ্যে বিলুপ্তির পথে রয়না, সরপুটি, বাইম, তারা বাইম আর পাবদা মাছ।

এসব মাছের প্রজননস্থানগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিশেষত পানি সেচে একেবারে শুকিয়ে মাছ শিকার ও চাষাবাদ করা, অবাধে কীটনাশক ব্যবহারে রেণু পোনা ধ্বংস হচ্ছে বিধায় বরিশাল অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, মৎস্য দপ্তর থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ ও শামুক উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প সাতক্ষীরা জেলার আশ-পাশে কিছু জেলায় চালু রয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশীয় মাছ সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে। তবে কি পরিমাণে মাছ কমেছে, কি কি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে তার তথ্য বা পর্যালোচনা নেই বলে স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।