নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : গতকাল বুধবার সকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান।
সফরের শুরুতেই প্রধান উপদেষ্টা দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ৫ নম্বর ইয়ার্ডে গিয়ে তিনি বন্দরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি: ড. ইউনূস বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর আমার কাছে অপরিচিত নয়। ছোটবেলায় জাহাজ দেখতে এসেছি এখানে। সেই সময় মাল খালাস হতো কাঁধে করে, এরপর ক্রেন এলো-সেই সময় থেকে এখনকার এই অবস্থায় পৌঁছেছে বন্দর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর। বিশ্বের অন্যান্য বন্দর অনেক দূর এগিয়ে গেছে, আমরা রয়ে গেছি পিছিয়ে।” তিনি বলেন, “বন্দরকে যদি সত্যিকার অর্থে আধুনিক ও কার্যকর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উন্নত বিশ্বের সেরা বন্দর পরিচালকদের হাতে বন্দরের দায়িত্ব দিতে হবে।”
অর্থনীতির হৃদপি- : চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপি-। এই হৃদপি- দুর্বল হলে দেশের অর্থনীতি সচল হবে না। বর্তমান সাইজের বন্দর দিয়ে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। বিশ্বমানের বড় আকারের বন্দর গড়ে তুলতেই হবে।” তিনি আরও বলেন, “এই বন্দর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আশেপাশের দেশ যেমন নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে আমরা সবাই লাভবান হবো।”
নৌপরিবহন উপদেষ্টার মন্তব্য: নৌপরিবহন উপদেষ্টা ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার বন্দর পরিদর্শন আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। তিনি বরাবরই বন্দরের প্রতি মমত্ববোধ দেখিয়েছেন। গত আট মাসে যেসব প্রকল্প উপস্থাপন করেছি, তিনি তাৎক্ষণিক অনুমোদন দিয়েছেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে বন্দরের দৃশ্যমান পরিবর্তন হবে বলে আমি আশাবাদী।” তিনি আরও জানান, বন্দর সম্প্রসারণে মাল্টি-মোডাল কমিউনিকেশন ব্যবস্থা, আলাদা পোর্ট রোড এবং উন্নত অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
অন্য কর্মসূচি: পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টার বহর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে তিনি কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের জমি হস্তান্তর, জলাবদ্ধতা সমস্যা নিয়ে ব্রিফিং এবং অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়ক উন্নয়ন সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও কর্ণফুলীতে হচ্ছে দুটি নতুন হাসপাতাল, কালুরঘাটে ডেন্টাল কলেজের পরিকল্পনা : হাটহাজারী ও কর্ণফুলী উপজেলায় দুটি পৃথক হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। পাশাপাশি, কালুরঘাট এলাকায় একটি ডেন্টাল কলেজ ও ডেন্টাল হাসপাতাল গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বুধবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত "চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং অক্সিজেন-হাটহাজারী মহাসড়কের উন্নয়ন" বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য উঠে আসে। সভায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সভাপতিত্ব করেন। তাঁর সঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি. আর আবরার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, প্রধান উপদেষ্টার স্পেশাল এনভয় লুৎফে সিদ্দিকী, বিডার চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অতিরিক্ত রোগীর চাপে সৃষ্ট পরিস্থিতি তুলে ধরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, “হাসপাতালটির ধারণক্ষমতা ২২০০ হলেও সেখানে প্রায় ৫ হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। ব্রেইন সার্জারির রোগীকে ফ্লোরে শুইয়ে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে, এমনকি টয়লেটের পাশেও রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ অবস্থায় হাটহাজারী ও কর্ণফুলীতে দুটি হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “রাঙামাটি ও কাপ্তাইয়ের দিকের রোগীরা হাটহাজারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। আর কর্ণফুলীর হাসপাতালটি পটিয়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ অঞ্চলের মানুষের সেবা দেবে।”
নূরজাহান বেগম জানান, চট্টগ্রামে বর্তমানে কোনো ডেন্টাল কলেজ বা ডেন্টাল হাসপাতাল না থাকায় এ খাতের চাহিদা পূরণে কালুরঘাট এলাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা জটিল সমস্যা, তবে সমাধান সম্ভব: প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস : চট্টগ্রাম শহরের দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা ধাপে ধাপে সমাধানের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি আশা প্রকাশ করেন, চলতি বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি পূর্বের তুলনায় অর্ধেকে নামানো সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যতে এটি শূন্যে নামিয়ে আনা যাবে।
বুধবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত "চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং অক্সিজেন-হাটহাজারী মহাসড়ক উন্নয়ন" বিষয়ক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, “জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরা অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা করেছি, এখন চাই বাস্তব পরিবর্তন। এটি একদিনে সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।”
তিনি আরও জানান, বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ায় এ বছর সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব না হলেও বিগত মাসগুলোতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগ ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
“যদি এই প্রচেষ্টার ফল এ বছর দৃশ্যমান না হয়, তাহলে তা জনআস্থায় চির ধরাবে,” বলেন তিনি। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, “চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা একটি জটিল সমস্যা। এটি নিরসনের মাধ্যমে দেশের অন্য শহরগুলোর জন্য একটি উদাহরণ তৈরি হতে পারে। চট্টগ্রামের যে সক্ষমতা রয়েছে, তা অন্য অনেক শহরের নেই। সেই সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে একসাথে এগোতে হবে।”
তিনি নিয়মিত নজরদারি ও সমন্বয় জোরদার করার নির্দেশ দেন এবং সকল প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা সি. আর আবরার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, প্রধান উপদেষ্টার স্পেশাল এনভয় লুৎফে সিদ্দিকী, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং এসডিজি মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
কালুরঘাট ব্রিজে আমার অনেক স্মৃতি -ড. ইউনূস : কালুরঘাটে বহুল প্রত্যাশিত কর্ণফুলী নদীর ওপর রেলসহ সড়ক সেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ভিত্তিপ্রস্তরের স্মারক ফলক উন্মোচন করেন তিনি। উদ্বোধন ঘোষণা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কালুরঘাট ব্রিজে আমার অনেক স্মৃতি। এই সেতুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। আজ এখানে বোয়ালখালীর বাসিন্দাও উপস্থিত আছেন। কালুরঘাট সেতু তাদের বহুল আকাক্সিক্ষত। এটি তৈরি হয়ে গেলে চট্টগ্রামবাসীর বহু কষ্টের অবসান হবে’।
এসময় সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন একটি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ। এখন যে সেতুটি আছে, ১৯৩১ সালে সেটি নির্মাণ করা হয়েছিল। যদি এর মেয়াদকাল ৮০ বছরও ধরা হয়, তবে ২০১১ সালে এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন পেল হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমি : আধুনিক হৃদরোগ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ পেল চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন। নগরীর পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় ২৩ একর জমি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে এক অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালামের হাতে জমির নিবন্ধিত দলিল তুলে দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ জানান, “দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটি স্থায়ী জায়গার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে সেই প্রতীক্ষার অবসান হলো। এই জমি বরাদ্দের মাধ্যমে আমরা হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করতে পারবো।”
প্রস্তাবিত হাসপাতালটিতে আধুনিক ক্যাথল্যাব, ওপেন হার্ট সার্জারি ইউনিট, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ), কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ), কার্ডিওলজি এবং কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ স্থাপন করা হবে। এছাড়াও, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত হৃদরোগীদের জন্য বিশেষ সেবা চালু রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন ২০২২ সালের ২৫ মে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি নগরের গোলপাহাড় মোড় এলাকায় একটি ভাড়া ভবনে বহির্বিভাগের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন জমিতে হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে হৃদরোগ সেবায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন শেখ আব্দুল্লাহ আলমগীর জানান, প্রধান উপদেষ্টা সকাল ৯টা ২১ মিনিটে চট্টগ্রামে অবতরণ করেন এবং ৯টা ৪২ মিনিটে বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করেন।