নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই ভারতের আগ্রহে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পতিত সরকার

নুুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, যোগাযোগ সহজীকরণ ও শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৮ সালে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু বাস্তবে এই সড়কের অধিকাংশ এলাকাতেই নেই উল্লেখযোগ্য জনবসতি।

পরিবেশ ও পার্বত্য শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শিল্প স্থাপনের যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তা কেবল মুখের কথা হয়েই রয়ে গেছে। আসলে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ফেনী-খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে শুরু করে রাঙামাটি, বান্দরবান হয়ে কক্সবাজারের ঘুনধুম পর্যন্ত বিস্তৃত ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সবচেয়ে বড় এ কথিত সীমান্ত সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে মূলত ভারতের স্বার্থে।

ফলস্বরূপ, তিন পার্বত্য জেলা তথা বৃহত্তর চট্টগ্রাম নতুনভাবে জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছে। অথচ এ ধরনের সড়ক নির্মাণের আগে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। আশার বিষয় হলো, জুলাই বিপ্লবের আওয়ামী লীগের পতনের পর বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার সড়কটির ব্যবহার ও নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সীমান্ত ২১৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলাকে ঘিরে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ফেনী-খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে কক্সবাজারের ঘুনধুম পর্যন্ত বিস্তৃত ১ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি সীমান্ত এতদিন সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ছিল না। প্রাকৃতিক দুর্গমতার কারণে বহিঃশত্রুর অনুপ্রবেশের শঙ্কা ছিল না বললেই চলে। সীমান্ত অপরাধ ও চোরাচালান রোধে বিজিবির কয়েকটি ক্যাম্পই যথেষ্ট ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি বদলেছে, এই অঞ্চল এখন নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

পতিত স্বৈরাচার সরকারের আমলে নির্মিত সীমান্ত সড়ক রামগড় থেকে শুরু করে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের ১২টি উপজেলাকে সংযুক্ত করেছে। দাবি করা হয়েছিলো, এটি উন্নয়ন ও যোগাযোগ সহজীকরণের অংশ। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে মূলত ভারতের আগ্রহেই। প্রাকৃতিকভাবে পাহাড় দিয়ে গড়ে ওঠা দুর্গম সীমান্তকে কোনো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছাড়াই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফেনীর সীমানা খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে কক্সবাজারের টেকনাফের ঘুনধুম পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সীমান্ত সড়ক প্রকল্প। অথচ এতদিন সীমান্ত চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি বিজিবি ক্যাম্পই যথেষ্ট ছিল। এখন এই সড়ক নির্মাণের ফলে অজান্তেই সার্বভৌমত্বের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

নতুন করে সাজাতে হবে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে মূলত ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সবচেয়ে দীর্ঘ, আর মিয়ানমারের অংশ তুলনামূলকভাবে ছোট। সামরিক সক্ষমতায় মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য বড় কোনো ঝুঁকি নয়। কিন্তু বিপরীত চিত্র ভারতের ক্ষেত্রে। ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তি, সীমান্তবর্তী কার্যক্রম ও প্রযুক্তি সবকিছুই মাথায় রেখে বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সাজায়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনারা যশোরের বেনাপোল, দিনাজপুরের হিলি, সিলেটের আখাউড়া এবং ময়মনসিংহের কামালপুর এই চারটি সীমান্তপথ ব্যবহার করে প্রবেশ করেছিল। সে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সমতলভিত্তিক সীমান্ত এলাকাকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে। এর বাইরে ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তকে সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। এ কারণে ওই অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখতে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টকে সমন্বিত করে বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর শীতকালীন সামরিক মহড়াও সমতলভিত্তিক হুমকিকে সামনে রেখে আয়োজন করা হয়।

পার্বত্য এলাকায় সেনা উপস্থিতি থাকলেও তা মূলত অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মোকাবিলায় সীমাবদ্ধ ছিল। বহিঃশত্রুর আক্রমণের কোনো শঙ্কা এতদিন সেখানে দেখা যায়নি। তবে ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে প্রথমবারের মতো দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল দিয়েই নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের মতে এতদিন সমতলের ঝুঁকিকে প্রাধান্য দিয়ে যে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা করা হতো এখন সেখানে যুক্ত করতে হবে পাহাড়ি দুর্গম এলাকা কিভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয় সেই বিষয়টিও। তাই সেনাবাহীনির প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায়ও আনতে হবে আমুল পরিবর্তন। ভারতের অরুনাচল ও কাশ্মিরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর মতো আধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে পুরো এলাকাটি হয়ে উঠবে ঝুঁকিপুর্ণ।

কোথায় কতদূর কাজ শেষ : সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় সড়ক নির্মাণের মূল প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তবে বাস্তবায়নের ভৌত অবকাঠামোগত কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পাহাড়ি আঁকাবাঁকা ও উঁচু-নিচু ভৌগোলিক অবস্থার কারণে কাজ শেষ হলে দৈর্ঘ্যে কিছুটা তারতম্য হতে পারে। এ বিশাল প্রকল্প তিনটি ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩১৮ কিলোমিটার সড়কের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে সীমান্ত সড়ক ২২০ কিলোমিটার এবং ৯৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। ইতিমধ্যে এই ধাপের ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

সংযোগ সড়ক : গিলাতলী-লোগাং (৮ কিমি), সাজেক-উদয়পুর (১২ কিমি), মারিশ্যা-মাঝিপাড়া (২২ কিমি), রাজস্থলী-সাইচল (৪০ কিমি), বগালেক-দোপানিছড়া (১৫ কিমি)।

ভারত সীমান্ত সড়ক (মোট ১২৪ কিমি) : রামগড়-তানাক্কাপাড়া (১৪ কিমি), তানাক্কাপাড়া-নাড়াইছড়ি (৩২ কিমি), বৈরাগীপাড়া-হারিঝাপাড়া (৪১ কিমি), মাঝিপাড়া (৫ কিমি), ধুলাছড়ি-লংলাই (৩২ কিমি)। মিয়ানমার সীমান্ত সড়ক (৯৬ কিমি) : বঙ্কুপাড়া-দোপানিছড়া (৯ কিমি), ঘুমধুম-বাইশফাঁড়ি-লেম্বুছড়ি-পোয়ামুহুরী-ফাতরাঝিরি (৮৭ কি.মি)।

৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত হবে ২৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক ও ১০৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। সংযোগ সড়ক : নাড়াইছড়ি-লক্ষীছড়ি-সীমানাছড়া (৩৩ কিমি), ফারুয়া-ফকিরাছড়ি (২৫ কিমি), তিন্দু-মদক (২০ কিমি), রুমা-গর্জনিয়া-জামছড়া (২৬ কিমি)। ভারত সীমান্ত সড়ক (২০১ কিমি) : অযোধ্যা-তানাক্কাপাড়া (৫১ কিমি), ভাগীরাতপাড়া-নাড়াইছড়ি (২৫ কিমি), বেতলিং-বৈরাগীপাড়া (২৫ কিমি), মাঝিপাড়া-ঘাসকাপাছড়া (২৫ কিমি), কারলাছড়া-বড়কারদিয়া (২৫ কিমি), কুঞ্জছড়া-থেগামুখ (২৫ কিমি), থালিপাড়া-ছাইতংপাড়া (২৫ কিমি)। মিয়ানমার সীমান্ত সড়ক : ফাতরাঝিরি-লিকরি (৫৫ কিমি)। শেষ ধাপে ৩০৭ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে থানচি-রেমাক্রি-মদক-লিকরি এলাকায় তৈরি হবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়ক।

ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি : সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহে আরেফিন জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শুরুতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৬৯৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে বাস্তবায়ন শেষে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

তিনি আরও জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। তবে তৃতীয় পর্যায়ের বিস্তারিত পরিকল্পনা এখনো হয়নি। কারণ পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় একসঙ্গে পুরো প্রকল্প পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়, তাই ধাপে ধাপে কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্পের অনুমোদনের পেছনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও আলোচনায় এসেছে। ২০১৮ সালে রাতের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার এক মাসের মাথায় এই সীমান্ত সড়ক প্রকল্প অনুমোদন করে। সমালোচকদের অভিযোগ, প্রকল্পটির মাধ্যমে ভারতের জন্য বিকল্প অনুপ্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে নতুন করে হুমকির মুখে ফেলে।

সীমান্ত সড়কের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৮ পয়েন্ট : সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সীমান্ত সড়কের আটটি স্থানে গুরুতর ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর হলো রামগড়ের কথিত স্থলবন্দরের ব্রিজ পয়েন্ট। এতদিন ফেনী নদী দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিভক্ত থাকলেও এখন সেই স্থানে ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগর থেকে দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারেরও কম হওয়ায় এই জায়গাটিকে কৌশলগতভাবে ‘বাংলাদেশের চিকেন নেক’ বলা হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের পর ভারতের একাধিক গণমাধ্যমে এই পয়েন্টটি দখলের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

এছাড়াও আরও কয়েকটি সংযোগ সড়ক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এগুলো হলো- সাজেক-উদয়পুর (১২ কিমি)। রাজস্থলী-সাইচল (৪০ কিমি)। ফারুয়া-ফকিরাছড়ি (২৫ কি.মি)। রুমা-গর্জনিয়া-জামছড়ি (২৬ কি.মি)। জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের মতে, পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সীমান্তজুড়ে আরও নতুন ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট তৈরি হবে।

পার্বত্য এলাকায় সীমান্ত সড়কের ঝুঁকি : সেনাবাহিনী-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের দিক থেকে পার্বত্য এলাকা দিয়ে হুমকি এলে তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলার মতো প্রস্তুতি এখনো নেয়নি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অধীনে তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি ব্রিগেড সক্রিয় রয়েছে খাগড়াছড়িতে ২০৩ ব্রিগেড, রাঙামাটিতে ৩০৫ ব্রিগেড এবং বান্দরবানে ৬৯ ব্রিগেড।

এই তিন ব্রিগেড মূলত অপারেশন উত্তরণ-এর আওতায় কাজ করছে, যার প্রধান দায়িত্ব অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমন। ফলে তারা হালকা অস্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত, ভারী অস্ত্রের প্রয়োজন এতদিন হয়নি।

অন্যদিকে রামুভিত্তিক ১০ পদাতিক ডিভিশন অপারেশন পূর্বপ্রাচীর-এর দায়িত্বে রয়েছে। তাদের মূল দায়িত্ব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধ এবং মিয়ানমার সীমান্ত সুরক্ষা। সূত্র জানায়, ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাসবাদকে উসকে দেওয়া হয়, এমনকি নিয়ন্ত্রণও করে তারা। ফলে ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি হলে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী তৎপরতা আরও বেড়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় অপারেশন পূর্বপ্রাচীরে নিয়োজিত সেনারা মিয়ানমার সীমান্ত ছেড়ে ভারতের দিকে মনোযোগ দিতে পারবে না। একইভাবে অপারেশন উত্তরণে ব্যস্ত সেনারাও অন্য দিকে সরে যেতে পারবেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সীমান্ত সড়ককে ঘিরে বাড়তি সুবিধা পাবে ভারতীয় সেনারা।

ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয় : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগে. জে. (অব:) শহীদ উল্লাহ চৌধুরী বলেন, সীমান্ত সুরক্ষার জন্য অনেক দেশে বিশেষায়িত সীমান্ত রোড ইউনিট থাকে। যেমন ভারতের বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন। বাংলাদেশে এমন একক বিশেষ বাহিনী নেই। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ পরিস্থিতিতে সীমান্তের নির্ধারিত সীমানার বাইরে সেনাবাহিনী ব্যবহার সীমাবদ্ধ; তাছাড়া পার্বত্য এলাকায় নির্মাণাধীন সীমান্ত সড়ক সাধারণত আন্তর্জাতিক সীমারেখা থেকে ২০০ মিটার থেকে ১,০০০ মিটার দূরে হওয়ায় সেখানে রীতিমতো সেনা স্থাপন করা যায় না। ফলে আপাতত সীমান্ত রক্ষার ভার বড় অংশে বিজিবির কাঁধেই রয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার শহীদ উল্লাহর মতে, ঝুঁকি কমাতে ন্যূনতম ব্যবস্থা হিসেবে নেওয়া উচিত: অন্তত দুটি কম্পোজিট ব্রিগেড রিজার্ভ রেখে। একটি রামগড় পয়েন্টে, অন্যটি পার্বত্য সংলগ্ন সমতলে; ওই ব্রিগেডগুলোকে পাহাড়ি ও জঙ্গলে কার্যকর অপারেশনের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম প্রদান করা; বিজিবির পাশাপাশি র‌্যাব স্টাইলের একটি প্যারা-মিলিটারি ইউনিট গঠন করা, যা অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবিরোধী কাজ ও সীমান্ত সড়ক রক্ষার জন্য বিশেষায়িত হবে; জঙ্গলঘেরা পাহাড়ি ব এলাকায় নজরদারির জন্য ড্রোনসহ আধুনিক মনিটরিং প্রযুক্তি দ্রুত করা; দুর্গম এলাকার বিওপিগুলোকে সীমান্ত সড়কের পাশে পুনঃস্থানান্তর করে তৎপরতা বাড়ানো; ব্রিগেডিয়ারের মতে এসব উদ্যোগ সময়সাপেক্ষ হলেও এখনই নেওয়া জরুরি নাহলে নতুন সীমান্ত সড়ক থেকেই সুরক্ষা হুমকিতে পড়বে।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : পাহাড়ের রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. ছালেহ শাহরিয়ার উল্লেখ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জিও-পলিটিক্যাল হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত। গত ১৬ বছর ধরে উন্নয়নের নামে এই এলাকা ভারতকে সুবিধা দিতে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে বর্ডার রোড প্রজেক্ট ভারতের বর্ডার কানেক্টিভিটি পরিকল্পনার অংশ, যা যদি কখনো শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেননেক বন্ধ হয়, তখন উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে টার্গেট করে।

সীমানা সড়কের মাধ্যমে স্থানীয়রা স্বল্প পরিসরে উপকৃত হলেও, প্রকল্প এলাকার জনবসতি খুব কম, তাই জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি বেড়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, সীমান্ত সড়ক ব্যবস্থার আগে সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ সড়ক নির্মাণ হয়ে গেলেও নিরাপত্তার পর্যাপ্ত পরিকল্পনা নেই। তাই সরকারের দ্রুত সামরিক হুমকির মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি পরিকল্পিত জনবসতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ নিশ্চিত করবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের সেভেন সিস্টারস রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত। ভারতের জন্য শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেননেক ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই বিকল্প পথ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যবহার করছে ভারত, যেখানে গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে নানা সংযোগ ও উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই চেষ্টা চালানো হয়েছে।