নাজমুল হুদা, রূপগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে উত্তেজিত জনতার দেয়া আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজী টায়ারস কারখানা। ৩২ ঘন্টা ধরে জ্বলা আগুনে শুধু কারখানাটিই পুড়ে যায়নিÑ অগ্নিকুণ্ডের গহ্বরে নিশ্চিহ্ন, নিখোঁজ হয়েছে ১৮২ জন উৎসুক জনতা। অগ্নিকাণ্ডের পরদিন থেকেই নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানার সামনে জড়ো হন। এক বুক আশা নিয়ে নিখোঁজদের স্বজনরা খুঁজে ফেরেন তাদের। একটা সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও নিখোঁজদের খুঁজে পাওয়া যায় নি। ফলে সময়ের সাথে সাথে তাদের জীবিত পাওয়ার আশাও ক্ষীণ ও হয়ে আসে। এক পর্যায়ে স্বজনরা নিশ্চিত হয়ে যান তাদের প্রিয় মানুষগুলো হয়তো আর বেঁচে নেই। প্রশাসনও স্বজনদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নিখোঁজদের নাম নিবন্ধন করেন। স্বজনদের দাবি নিখোঁজদের মরদেহ না পেলেও পোড়া হাড়ের অংশ হলেও হবে। যাতে তারা তাদের স্বজন মারা গেছে এটা নিশ্চিত হতে পারেন এবং ধর্মীয় রীতিতে সমাধিস্থ করতে পারেন। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজদের কোন হদিস মিলছে না। এতে স্বজনদের কান্না যেন থামছেই না। নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা এখনো স্বজনদের অপেক্ষায় আছেন। এদিকে নিখোঁজদের মৃত্যুর সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ায় অনেক পরিবার ঋন মওকুফ ও বিধবা বাতাসহ বিভিন্ন অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি ধর্মীয় আচারও করতে পারেননি তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক তীব্র অস্থিরতা। তার ভয়াবহ রেশ এসে লাগে রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চলেও। ক্ষমতার অপব্যবহার ও যবর দখলের জবাব দিতেই উত্তেজিত জনতা এক হয়। উপজেলার খাদন এলাকায় অবস্থিত গাজী টায়ারস কারখানায় তারা অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময়ও কারখানাটির বেশকিছু স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়। তখন লুটপাট চলে ৮ অগাস্ট পর্যন্ত।
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেফতারের পর নারায়ণগঞ্জের আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় সর্বশ্রেণির মানুষ, উৎসুক জনতা কারখানাটিতে গণহারে লুটপাট চালান এবং আগুন ধরিয়ে দেন।
আগুন লাগার সময়ও লুট করতে কারখানার ভেতরে গিয়ে ৪-৫ শতাধিক মানুষ ভেতরে আটকা পড়েন। এসময় দোতলা ও তিনতলার জানালা দিয়ে অনেকেই নিচে লাফিয়ে পড়েন। অন্যরা বের হতে পারেননি। গাজী গ্রুপের টায়ার তৈরির কারখানায় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ঘটনায় অন্তত ১৮২ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করেন পরিবারের সদস্যরা।
গত বছরের ২৭ অগাস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে ১২ সেপ্টেম্বর কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যদি ৫ আগস্টের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতো, তাহলে প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ভয়াবহ আগুন লাগা এড়ানো সম্ভব হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় তলা ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় তামা ও রাসায়নিক লুট করতে গিয়ে একদল অনুপ্রবেশকারী নিচতলার গেট বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে চলে যায়। ভবনে দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় ১৮২ জন নিখোঁজ হয়।
আগুনের ঘটনার পাঁচদিন পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর কারখানাটির সামনে গণশুনানির আয়োজন করে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি।
ওই সময় নিখোঁজ ৮০টি পরিবারের সদস্যরা তাতে অংশ নেন। গণ-শুনানি শেষে নিখোঁজের স্বজনরা বাধা উপেক্ষা করে ভবনে ঢোকেন এবং ভবনটি থেকে ১৫ খণ্ড হাড় উদ্ধার করেন। পরে তা পুলিশের কাছে জমা রাখা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও সাইফুল ইসলাম বলেন, গাজী টায়ারসে যখন আগুন লেগেছিল সেখানে বিভিন্ন কেমিক্যালছিল। কেমিক্যালের কারণে আগুনের তীব্রতা প্রকট আকার ধারণ করে এবং অতি উচ্চ তাপমাত্রা তৈরি হয়েছিল। সেখানে মেটাল পর্যন্ত পানির মত গলে গিয়েছিল। যে পরিবারগুলো দাবি করছিলেন যে তাদের স্বজনরা সেখানে গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলেন। সে কমিটি একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। স্বজনদের দাবির প্রেক্ষিতে এখান থেকে কিছু স্যাম্পল কালেক্ট করে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়েছে। যেহেতু স্বজনদের দাবি অনুযায়ী ১৮৪ জনের ডিএনএ আলাদা আলাদা ভাবে সনাক্ত করতে হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশেই রিয়েল ঘটনাটি জানা যাবে।
জেলা সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম বলেন, প্রশাসনের করা তালিকা ধরে পুলিশ নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করছে। এ বিষয়ে পুলিশের একটি টিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা সরে জমিনে মাঠ পর্যায়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা তদন্ত করছেন। তবে ইতিমধ্যেই আমরা ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট টি হাতে পেয়েছি। আশা করছি আগামী ১০ দিনের ভিতর নিখোঁজদের শনাক্তের বিষয়টি প্রকাশ করা হবে।