একসময় কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিয়ে উপলক্ষে ঝালরওয়ালা ভ্যান-রিকশার বহর বর বা কনের বাড়িতে যাওয়ার দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক। চারদিক কাপড়ঘেরা রিকশা-ভ্যানে নতুন বউ স্বামী কিংবা বাপের বাড়ি যাওয়া ছিল ঐতিহ্য। পালকীর পরেই রিকশা-ভ্যানের এই রাজত্ব ছিল কয়েক যুগ আগেও। এসব দৃশ্য এখন পালটে গেছে। মাইক্রোবাস আর প্রাইভেট কার এখন সেই জায়গা দখল করেছে।
ভ্যান-রিকশা এখন থাকলেও পাল্টে গেছে ধরন। সেই প্যাডেলওয়ালা পায়ে টানা ভ্যান-রিকশা আর তেমন চোখে পড়ে না। এর স্থলে এখন সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত ভ্যান-রিকশা, অটোরিকশা। বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ শহর-গ্রামের সড়ক চলে গেছে বিদ্যুৎ চালিত এসব যানবাহনের দখলে।
বিজ্ঞানের উন্নতিতে পিছিয়ে পড়ছে পুরনো এই ভ্যান-রিকশার ব্যবহার। একসময় কাঁচা বা পাকা সড়কে ছুটে চলতো তিনচাকার পায়ে টানা এসব ভ্যান-রিকশা। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার রিকশা ও ভ্যানের দাপটে অনেকেটাই হারিয়ে যেতে বসেছে পায়ে টানা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গরীবের এই বাহনটি। অথচ প্যাডেলওয়ালা পায়ে টানা ভ্যান-রিকশাই পালকীর পরে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ছিল।
বর্তমানে ব্যাটারিচালিত ভ্যান-রিকশায় গতি বেড়েছে ঠিক, কিন্তু গ্রামীণ এ বাহনের সেই আবেদনটা কমেছে অটোর দাপটে। পায়ে টানা ভ্যান-রিকশা শুধু ঐতিহ্যবাহীই নয়, এটা মূল্য সাশ্রয়ীও ছিল। ব্যাটারিচালিত ভ্যান-রিকশায় বিদ্যুৎ খরচ হয়। তা বাংলাদেশের মতো লোডশেডিং প্রবণ দেশে সমস্যাই তৈরি করেছে। তবে পায়ে টানা ভ্যান-রিকশার ইতিহাস মানুষের দাসত্বের ইতিহাস। এটা মানুষকে ভারবাহী পশুর সমতুল্য করে তোলে। বিদ্যুৎ চালিত ভ্যান-রিকশা মানুষকে সেই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই আধুনিক কালেও মানুষ কেন মানুষকে টানবে? এমন কথাও মন্দ নয়!
আবার প্রযুক্তির কল্যাণে এগিয়ে যাওয়াই কালের নিয়ম। আগে ভ্যান-রিকশা চালাতে মানুষের যে কষ্ট হতো, তা দেখার মতো নয়। অনেক গরিব মানুষ শারীরিক শক্তির অভাবে এটা চালাতে পারতেন না। প্রযুক্তি সেই পরিস্থিতি পালটে দিয়েছে। এখন অনেক বৃদ্ধ ব্যক্তিও ভ্যান-রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে।
এদিকে শহরের পৌরসভা বা গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদও ব্যাটারী চালিত বাহনের দোহায় দিয়ে লাইসেন্স বাবদ মোটা অংকের টাকা আদায় করছে।
সরেজমিনে কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, ভ্যান-রিকশা প্রচুর, তবে এর প্রায় সবগুলোই ব্যাটারিচালিত। গ্রাম বা শহরে দু‘একটা পায়ে টানা ভ্যান-রিকশা রয়েছে, যদিও তাদের কদর নেই। অগত্তা নিরুপায় না হলে কেউই পায়ে টানা ভ্যানে যাত্রী হতে আগ্রহী হয় না। পায়ে টানা ভ্যানে যাত্রীর পরিবর্তে মাল ছামানাই বেশি পরিবহন করা হচ্ছে।
কথা হয় কুষ্টিয়া শহরের অটোরিকশার চালক আবুল হোসেনের সাথে। সে জানায়, মানুষ এখন দ্রুত যেতে চায়। এ কারণে সবাই অটোরিকশাই পছন্দ করে অটোতেই ওঠে। ভ্যান-রিকশা এখন যেন সে কালের বাহন, আবার মটর (ব্যাটারী) না থাকলে কেউ উঠতেই রাজি হয় না।
কুমারখালী শহরতলীর কেশবপুর গ্রামের ভ্যান চালক রায়হান শেখ জানায়, আগে সেও পায়ে টানা ভ্যান চালাতো। কষ্ট হলেও ওটাই চালাতে ভালো লাগত। পরিশ্রম বেশি হওয়ায় এতে শরীরও ভালো থাকত। রাতে ভালো ঘুম হতো। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত ভ্যানে টাকা রোজগার বাড়লেও শরীরের তেমন পরিশ্রম হয় না। ফলে ঘুমও আগের মত হয় না। একই এলাকার রবিউল ইসলাম রবি রোগাটে দূর্বল ভ্যান চালক। সে জানায়, পায়ে টানা ভ্যানেই আমার ভালো লাগে। যতদিন পারবো এভাবেই চালাবো। অল্প রোজগারেই ভালো থাকি।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিভিন্ন যানবাহনের এই পরিবর্তন হয় তো আগামীতে পালকীর মত পায়ে টানা ভ্যান-রিকশাও যাদুঘরে স্থান নেবে একথা বলায় যায়। আর সে দিন হয় তো আর খুব বেশি দুরে নয়!