একেএম আবদুর রহীম, ফেনী
আন্তর্জাতিক সীমানা আইনের কোন তোয়াক্কাই করছে না ভারত। তাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী(বিএসএফ) বাংলাদেশের ব্যাপারে পেশাদার আচরণ কখনো করেনি। বাংলাদেশীরা ধান কাটতে গেলে ধরে নিয়ে যাওয়া, গরু চরাতে গেলে গুলী করা, নদীতে গোসল করতে গেলে হৈ হৈ করে তেড়ে আসা, জমির পাকা ধান কেটে নিয়ে যাওয়া, কৃষককে তার গরু সমেত ধরে নিয়ে যাওয়া, সীমান্তের অনেক ভিতরে এসে গুলী করে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেশী এই দেশটি আমাদের মুহূরীর চর জোর করে দখল করে রেখেছে। অতীতের কোন সরকার এই চর পুনরুদ্ধারের কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
বর্ষায় তারা অভিন্ন নদী মুহূরী কহুয়া নদীর পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। সীমান্তে বানর ছেড়ে দিয়ে সীমান্তবাসীদের ফসল ধ্বংস করে। হয়ত মনে হবে বনের বানর ফসল খেয়ে নেয় এতে ভারতের কি দোষ। বিষয়টা এরকম নয়। তারা তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গাড়ি ভর্তি করে বানর ধরে এনে এখানে ছেড়ে দেয়। আর সেসব বানর নেমে পড়ে বাংলাদেশীদের খেতে খামারে, বাড়ি-ঘরে।
ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার ১৩৩ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্ত। এই সীমান্ত এলাকায় বছরের পর বছর যাবৎ চলছে বাংলাদেশীদের প্রাণ হরণ।
বিএসএফের গুলীতে নিহতের লাশ কখনো শূন্য রেখায়, কখনো ভারতের ভেতরে, কখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাওয়া যায়। এসব হত্যাকান্ড বন্ধে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। হত্যাকান্ডের পর পতাকা বৈঠক, লাশ হস্তান্তর এ পর্যন্তই। আজ পর্যন্ত এসব পরিবার কখনো কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। এদের পুনর্বাসনে সরকার কখনো এগিয়ে আসেনি।
বিএসএফের হামলায় অসংখ্য আহত নিহতের একজন পরশুরাম উপজেলার মেজবাহার। সংগ্রামের পক্ষ থেকে তার খোঁজ খবর নিতে গিয়ে উঠে আসে তার পরিবারের করুন কাহিনী।
২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর কৃষক মেজবাহারের(৪২) সীমান্ত এলাকায় বর্গা জমির ধান কাটতে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ জোর করে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে। অকাল মৃত্যুতে তার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকুল সাগরে পড়ে পরিবারটি। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার উত্তর গুথুমা গ্রামের টিলাপাড়ার মৃত মফিজুর রহমানের একমাত্র ছেলে মেজবাহার। মেজবাহ’র হত্যাকা-ের তিন বছর শেষ হয়েছে স্ত্রী এবং চার কন্যার সাজানো সংসার ছিল মেজবাহের। অন্যের জমি বর্গা চাষ করেই চলছিল পাঁচ জনের সংসার। কিন্তু এখন আর চলছে না সংসার। বসতঘর ভেঙে পড়ছে, মেরামত করার সাধ্য নেই।
অর্থের অভাবে মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ। ধরে নিয়ে যাওয়ার তিনদিন পর সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে শূন্য রেখায় ভারতীয় অংশে মেজবাহের লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা। পরে লাশ বিএসএফ নিয়ে যায় এবং ১৭ দিন পর ২৯ শে নভেম্বর বিলোনিয়া চেকপোস্ট দিয়ে মেজবাহের গুলীবিদ্ধ গলিত লাশ বিজিবির মাধ্যমে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে নিরীহ কৃষক মেজবাহারকে হত্যা করে বিএসএফ। মৃত্যুর আগে ৬ লাখ টাকা ধার দেনা করে বড় মেয়ে মর্জিনা আক্তার (২১) কে বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই টাকা এখনো পরিশোধ হয়নি। মেজবাহের স্ত্রী মরিয়ম আক্তার (৪০) বলেন, তাদের কষ্টের কোন সীমা পরিসীমা নাই। বেতের কাজ করে ঝুড়ি, ওড়া, লাই ইত্যাদি বানিয়ে তিনি বিক্রি করেন। এতে সামান্য লাভ হয়। তাই দিয়েই চলছে কোন রকমে। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলে চালার ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। বিয়ের উপযুক্ত তিনটি মেয়েকে নিয়ে পুরুষ বিহীন জীবনে দিবানিশি আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়।
সীমান্তের বাসিন্দা ইদ্রিস আলী মনির হোসেন সহ আরো কয়েকজন কৃষক সংগ্রামকে জানান, বিএসএফ সব সময় সীমান্ত এলাকায় যেতে বাধা দেয়। আমরা চাষাবাদ করতে, ফসল কাটতে যেতে পারি না। গরু চরাতে পারি না, ঘাস কাটতে পারি না। তারা যখন তখন বিনা কারণে গুলী করা শুরু করে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)এর ফেনী জেলা সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, “বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা করে মীমাংসা করা উচিত”।
এড. জামাল উদ্দিন এপিপি বলেন “এসব হত্যাকা- আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন । এর স্থায়ী প্রতিকার হওয়া দরকার”। বিশিষ্ট সাংবাদিক ইউসুফ আলী বলেন, “প্রতিটি হত্যাকা-ে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েছে। নিহতের অসহায় পরিবারের দায়িত্ব নেয়া সরকারের উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন”।
ফেনীস্থ ৪ বিজিবির অধিনায়ক লেঃ কর্নেল মোশাররফ হোসেন বলেন, “অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম না করলে সীমান্ত হত্যা হবে না। চোরাচালান রোধ সহ সীমান্ত বাসীদের সচেতন করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি” ।