খালিদ হাসান সিপাই, কুষ্টিয়া : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় এক গণঅভ্যুত্থানের দিন। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে সেদিন কুষ্টিয়াসহ সারাদেশে উত্তাল হয় ছাত্র-জনতা। তবে কুষ্টিয়ায় সেই আন্দোলন রক্তাক্ত ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয়। পুলিশের গুলীতে ও সরকারি দলের সন্ত্রাসে প্রাণ হারান কুষ্টিয়ার অন্তত ১৬ জন, আহত হন ৫৮৩ জন। শহীদ পরিবারগুলো এক বছর পরও বিচার না পাওয়ায় চরম হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন । সেদিন ছাত্র জনতার বিক্ষোভে পুলিশ হামলা চালায়। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলী ও টিয়ারশেল ছোড়া হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলীতে শত শত ছাত্র-জনতা আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সাথে সাথে আহতদের এবং নিহতদের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশের গুলীতে ১৬ জন শহীদ হন। আহত হয় আরো ৫৮৩ জন।
কুষ্টিয়ায় শহীদরা হলেন লাহিনী পাড়ার জুবায়ের আহমেদ ও জামাল উদ্দিন শেখ, কুমারখালীর সুলতানপুরের শায়খ আসহাবুল ইয়ামিন, চরজগন্নাথপুর গ্রামের সেলিম মন্ডল ও আব্দুস সালাম, শিলাইদহ কসবার আলমগীর হোসেন, কুষ্টিয়া শহরের চরথানাপাড়ার আব্দুল্লাহ আল মুসতাকিন, চর আমলা পাড়ার সবুজ আলী, হাটশ হরিপুরের বাবলু ফারাজি, শালদহের আশরাফুল ইসলাম ও সুরুজ আলী, সদর উপজেলার দহকোলা গ্রামের উসামা, খোকসা জানিপুরের মারুফ হোসেন, খোকসা চাদটের মাহিম হোসেন, চর থানাপাড়ার ইউসুফ শেখ, ভেড়ামারা উপজেলার কলেজ পাড়ার মো: কবির।
কুষ্টিয়া পৌরসভার চর থানাপাড়ার মৃত এদাত আলী শেখের ছেলে শহীদ ইউসুফ শেখ তার মেয়ে সীমা খাতুন জানান,‘আমার বাবার কপাল ও শরীরের বিভিন স্থানে গুলী লেগেছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে পুলিশ তাকে গুলী করে হত্যা করে। এসআই আলী ও মুস্তাফিজ প্রকাশ্যে বাবাকে গুলী করে। তাদের নামে থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তা নেয়নি। হত্যার ১০ দিন পরে মামলা হয়। এ মামলায় অনেক নির্দোষীদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুবিধাবাদীরা এ মামলা নিয়ে স্বার্থ হাসিল করেছে। তারা তাদের মনমতো মামলা সাজিয়েছে, নাম ঢুকিয়েছে। এরপর কয়েকজনের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তারা বাণিজ্য করেছে। এজন্য বিভিন্ন সময় তারা আমার সই নিয়েছে। মামলা নিয়ে তারা ব্যবসা করেছে। এক বছরেও আমরা হত্যার বিচার পায়নি’, আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া ইউসুফের মেয়ে সীমা খাতুন। শহীদ ইউসুফ শেখ কুষ্টিয়া পৌরসভার চর থানাপাড়ার শহীদ আবুল কাশেম সড়কের মৃত এদাত আলী শেখের ছেলে। তিনি কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে চাকরি করতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কুষ্টিয়া ফায়ার সার্ভিসের সামনে নূর টেইলার্স গলির ভেতরে আন্দোলকারী ইউসুফকে গুলী করে হত্যা করা হয়। তার কপালে ও শরীরের বিভিন্নস্থানে গুলী লাগে। ইউসুফ হত্যার এ ঘটনায় হওয়া মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা পাশাপাশি মোট ৭৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ২০ থেকে ৩০ জনকে।
ইউসুফ হত্যা মামলার বাদী তার মেয়ে সীমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট সকালে আমাদের বাসার গলিতে এলোপাতাড়িভাবে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও ছররা গুলী ছোঁড়ে। সকাল ৯টার দিকে ছররা গুলীতে আহত হন বাবা। পরে আহত অবস্থায় সে আন্দোলনে যায়। দুপুরে ফায়ার সার্ভিস অফিসের সামনের গলিতে পুলিশের গুলীতে তিনি প্রাণ হারান। ’ ইউসুফের মতো জুলাই আন্দোলনে কুষ্টিয়ায় ১৬জন শহীদ হন। এসব শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা হলেও এতে তেমন অগ্রগতি নেই। দীর্ঘ এক বছরেও বিচার না পেয়ে হতাশ শহীদ পরিবারের সদস্যরা। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কুষ্টিয়া শহরের থানার মোড় এলাকায় বাবলু ফারাজীকে (৫৮) গুলী করে হত্যা করা হয়। তিনি শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফেরি করে গামছা, বিছানার চাদর ও লুঙ্গি বিক্রি করতেন। বাবলু ফারাজী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামের মৃত নওশের আলীর ছেলে। এ ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট নিহত বাবলু ফারাজীর ছেলে সুজন মাহমুদ বাদী হয়ে কুষ্টিয়া আদালতে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই।
মামলার বাদী সুজন বলেন, ‘৫ আগস্ট বাবা আন্দোলন করছিল। শহরের মিশন স্কুলের বিপরীতে তুলা পট্টির গলিতে পুলিশের গুলীতে তিনি শহীদ হন। পুলিশের গুলী বাবার মাথার ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রথমে পুলিশের নামে মামলা করতে গেলে থানা তা নেয়নি। যার জন্য আদালতে মামলা করেছি। পিবিআই তদন্ত করছে। দোষী পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এক বছর হয়ে গেল, কিন্তু আমরা বিচার পাচ্ছি না। ’ ৫ আগস্ট বিকালে পুলিশের গুলীতে শহীদ হন মোহাম্মদ ওসামা। তিনি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার শিমুলিয়া দহকুলা গ্রামর জয়নুল আবেদীনের ছেলে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লাশ দাফন করা হয়। ওসামা ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের আলামপুর ইউনিয়নের সংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন।
ওসামার বাবা জয়নুল আবেদীন বলেন, আন্দোলন চলাকালে থানার মোড় এলাকায় পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারায় ছেলে। তার ঘাড়ে গুলী লেগেছিল। এ ঘটনায় আমরা মামলা করিনি। সে শহীদ হয়েছে। আমরা আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম, আল্লাহ যেন আমার ছেলেকে জান্নাতবাসী করে। এসপি, ম্যাজিস্ট্রেটরা বাসায় এসে নিষ্পত্তির জন্য কাগজপত্রে সই নিয়ে গেছেন।’
কুষ্টিয়ায় শহীদ হওয়া সুরুজ আলীর স্ত্রী ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীকে গুলী করে হত্যা করেছে পুলিশ। হত্যার এক বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু আমরা বিচার পেলাম না। আমরা মামলা করার আগেই একজন ব্যক্তি মামলা করেছে। এ মামলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এ মামলায় অর্থ বাণিজ্য করা হয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে নির্দোষীদের অব্যাহতি দেওয়া হোক। আর দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। ’
শহীদ আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী লাবণী আক্তার ইতি বলেন, ‘আমার স্বামীকে প্রকাশ্যে গুলী করে হত্যা করেছে পুলিশ, যা সবাই দেখেছে। কিন্তু মামলায় পুলিশের নাম দিতে দেওয়া হয়নি। হত্যার এক বছরেও আমি আমরা স্বামী হত্যার বিচার পেলাম না। আমরা খুব হতাশ।’ জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কুষ্টিয়া শহরে পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারায় ছয়জন। এছাড়া পুলিশের টিয়ারশেলে একজন ও যুবলীগের হামলায় আরেকজনের মৃত্যু হয়। বছর পেরিয়ে গেলেও থামেনি শহীদ পরিবারগুলোর কান্না। শহীদদের স্মৃতি আগলে রেখে দিন পার করছেন তারা। হত্যার এক বছরে আশানুরূপ বিচার না হওয়ায় হতাশ তারা। হত্যাকান্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার, বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন শোকে বিহ্বল শহীদ পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, সম্মানজনক পুনর্বাসন ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করে আসছি। প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্রের ব্যাংক চেক দেওয়া হয়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এককালীন দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। কেউ কোনো সাহায্য সহযোগিতার আবেদন করলে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছি। এছাড়াও প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসন, আবাসন সুবিধা ও চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান বলেন, জুলাই গণভ্যুত্থানে আহত ও নিহতের ঘটনায় হওয়া মামলাগুলো আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। তদন্ত কাজের অগ্রগতি ভালো। এ বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও রেঞ্জ থেকে একটা কমিটি আছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। এক বছর অতিক্রন্ত হলেও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় শহীদ পরিবারগুলো ক্ষোভ, হতাশা ও বেদনার মাঝে দিন কাটাচ্ছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কুষ্টিয়া শহরে আওয়ামী ক্যাডারদের নির্দেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলী চালিয়ে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের প্রমাণ সাপেক্ষে কঠোর বিচার দাবী করেছেন শহীদ পরিবার ও এলাকাবাসী।