বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলে মাছের চরম আকাল দেখা দিয়েছে। সুন্দরবনের দুবলার চর কেন্দ্রিক জেলেরা গেল আমাবস্যার গোণে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে জাল ফেলে খালি হাতে উপকূলে ফিরে এসেছেন। এ অবস্থায় সাগর পাড়ের জেলে বিভিন্ন জেলে পল্লীর শুঁটকি তৈরির চাতালগুলো এখন মাছের অভাবে খাঁ খাঁ করছে। চলতি মওসুমের সময়ের মধ্যে জেলেদের মাছ ধরার বাকী সময় আছে আগামী পূর্ণিমার গোণ। এই সামনের গোণে যদি মাছ পাওয়াও যায় তা দিয়ে পুরো মওসুমের সংকট কিভাবে পূরণ করবেন তা নিয়ে হা হুতাশ করছেন দুবলার চরের জেলে ও মৎস্যজীবীরা। প্রায় শেষ দিকে এসে স্মরণকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে বর্তমানে সাগরে মাছের চরম আকাল দেখা দেয়ায় জেলে ও মৎস্যজীবীরা এখন দারুণভাবে আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন। জেলেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে সামনের ঈদ উৎসব পালন করবেন না কি দেনা করে লগ্নি করা টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন তা নিয়ে উৎকণ্ঠা আর হতাশা প্রকাশ করছেন। জেলে পরিবারগুলোতে নেই কোনো ঈদের আমেজ। এদিকে সাগরে পর্যাপ্ত মাছ আহরণ না হওয়ায় এবার বন বিভাগেরও তাদের টার্গেট রাজস্ব আয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। সুন্দরবনের দুবলার চরের বিভিন্ন জেলে ও মৎস্যজীবী ও বন বিভাগ সূত্র জানায়, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলের দুবলার চর এলাকায় গত নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয়েছে পাঁচ মাসব্যাপী সাগরে শীতকালীন মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ মওসুম। আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে এ মওসুম। মৎস্য আহরণকালীন সময়ে জেলে ও মৎস্যজীবীরা নৌকা ও ট্রলারে করে সাগর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণের পর তা সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করে থাকেন। এ সময় সুন্দরবন উপকূলের হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীরা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে এখানে মাছ আহরণ ও শুঁটকি তৈরিতে জড়ো হন। সাগর থেকে মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি তৈরিকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনের পুরো উপকূল এলাকায় জেলে ও মৎস্যজীবীরা বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে ব্যাপক ব্যস্ত সময় পার করে থাকেন। কিন্তু এবারের মওসুমের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। জেলে ও মৎস্যজীবীদের মনে শান্তি নেই। বিরাজ করছে দারুণ হতাশা আর উৎকণ্ঠা। মওসুমের শুরু থেকেই সাগরে মাছ সংকটে বিপাকে পড়েছেন জেলে মৎস্যজীবীরা। সর্বশেষ পূর্ণিমার গোণেও সাগরে জাল ফেলেও তেমন কোন দেখা পাননি তারা। মাছ না পেয়ে জেলে মহাজনরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। গেল গোনে সাগরের সুন্দরবন উপকূলে পশ্চিমা বাতাস প্রবাহিত হওয়ার কারণে জেলেরা নৌকা ট্রলার ও জাল নিয়ে গভীর সাগরে যেতে পারেননি। কেউ কেউ প্রতিকূল বাতাস উপেক্ষা করে সাগরে গিয়ে জাল ফেললেও তারাও তেমন মাছ পাননি। সাগরে গিয়ে মাছের অভাবে খালি হাতে সুন্দরবনের জেলে পল্লীতে ফিরে এসেছেন। ট্রলারের তেল খরচও ওঠেনি।

দুবলার চরের মোংলা রামপাল মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির শেখ জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি সাগরের মাছ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বর্তমানের মাছ সংকটের মতো অবস্থা তিনি কখনই দেখেননি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পশ্চিমা বাতাসের কারণে কোনো মাছ পড়ছে না। এ ছাড়া বাতাসের তীব্রতায় জাল নৌকা নিয়ে জেলেরা সাগরে গভীরে যেতে পারেনি।

সাগরের অধিকাংশ জেলে ও মৎস্যজীবীদের একই পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সামনে ঈদ। কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া পরিবার পরিজনও তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় ঈদ উদযাপনতো দূরের কথা লগ্নির টাকা কি করে পরিশোধ করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না।

মোংলার চাঁদপাই ইউনিয়নের কানাই নগরের কামাল হোসেন দুবলার চরের আলোর কোলের মৎস্যজীবী। তিনি জানান, তার তিনটি নৌকা ট্রলারে মওসুমে প্রতি লাখে ২৫ হাজার টাকা করে দাদনে মোট ৫০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে সাগরে এসেছেন। এবার মওসুম শেষ হতে চললেও আয় করেছেন সব মিলিয়ে ২০ লাখ টাকার মতো। লাভ তো দূরের কথা, পুঁজির অর্ধেকও এখন পর্যন্ত তোলা যায়নি। এ অবস্থায় তিনি বাড়ি ফিরে কি করে তা পরিশোধ করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না।

সাগরের মৎস্যজীবীদের বৃহৎ সংগঠন দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শক্তিশালী পশ্চিমা বাতাসের কারণে গেল গোনে সাগরে মাছ পড়েনি। যা চলতি মওসুমের মধ্যে সবচেয়ে রেকর্ড। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সাগরে মাছের সংকট বেশি দেখা গেছে। বর্তমানে মাছ না থাকায় সুন্দরবনের বিভিন্ন চরের মাছ শুঁকানোর চাতাল ও মাচা মাছের অভাবে খাঁ খাঁ করছে। এ অবস্থায় অনেক মৎস্যজীবীর বাড়িতে ফিরে কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করাও কষ্ট হয়ে যাবে।