জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে জুলাই আন্দোলনে নিহত পরিবারের সদস্যরাও এসেছেন। তারা সমাবেশ থেকে নির্বাচনের আগেই জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা জুলাই সনদ ঘোষণার দাবিও জানিয়েছেন।

গতকাল শনিবার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সমাবেশে জুলাই শহীদদের পরিবারের কয়েকজন সদস্য বক্তব্যে এই দাবি জানান। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী ও আবুল হোসেন, শহীদ আবরার ফাহাদের পিতা বরকত উল্লাহ, শহীদ আলী রায়হানের পিতা মুসলেম উদ্দিন, শহীদ আলিফ মাহমুদের পিতা সৈয়দ নাজিউর রহমান, শহীদ আনাসের পিতা শাহরিয়ার খান পলাশ, শহীদ গোলাম নাফিসের পিতা গোলাম রহমান, শহীদ হাফেজ জুবায়ের আহমদের পিতা কামাল উদ্দিন, শহীদ শাহরিয়ার আলভির পিতা আবুল হাসান, শহীদ সিফাতের পিতা কামাল হাওলাদার, শহীদ জিহাদ হোসেনের পিতা মোশারররফ হোসেন, শহীদ আহসান হাবিব তামিমের পিতা আব্দুল মান্নান, শহীদ আদিলের পিতা আবুল কালাম, শহীদ আব্দুল্লাহ আল মাহির পিতা জামিল হোসেন সোহেল, শহীদ ইমাম হাসান তাইয়েমের ভাই রবিউল আওয়াল ভূইয়া, শহীদ মোবারক হোসেনের পিতা দেলোয়ার হোসেন, শহীদ মারুফ হোসেনের পিতা মো. ইদ্রিস, শহীদ ফয়সাল আহমদ শান্তের পিতা জাকির হোসেন, শহীদ সাংবাদিক আবু তুরাব এর ভাই আবু , আহত জুলাইযোদ্ধা নর্থ সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের এস এম মোস্তাফিজুর রহমান, আহত জুলাইযোদ্ধা মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্র জুনায়েদুর রহমান, উত্তরার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র রেজওয়ান নাবিল, আহত জুলাইযোদ্ধা আহসান আল মামুন ও মনিরুল ইসলাম, সৌদি প্রবাসী মাইনুদ্দিন বাবু, রবিউল করিম প্রমুখ।

সমাবেশে বক্তব্য দেন রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী। তিনি বলেন, ১৬ জুলাই যখন আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে জীবন দিয়েছিল, যে কারণে জীবন দিয়েছিল, সেই কারণের বাস্তবতা কি আমরা আজ পেয়েছি? যদি সেই শহীদ ভাইয়ের বাস্তবতা আমরা না পাই তবে এই বাস্তবতা আমরা ফেরত চাই। না হলে আমরা আমাদের শহীদ ভাইদের ফেরত চাই। চব্বিশের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান শহীদ ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ পেয়েছি। রমজান আলী বলেন, আমরা গত ১৭ বছর কি এমন সমাবেশ করতে পেরেছি? যদি না পেরে থাকি তবে আমাদের ভাইয়ের অধিকার, সেই অধিকার আমরা ফেরত চাই। যদি ফিরিয়ে না পাই, তাহলে আমাদের ভাইদের ফিরিয়ে দেন।

আবু সাঈদের ভাই বলেন, আজ দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু এই বাংলার মাটিতে আমরা একজন শহীদ ভাইয়ের হত্যার বিচারও পাইনি। আমাদের শহীদ ভাইদের হত্যার বিচারের দরকার আছে কি নাই? আমি মনে করি, নির্বাচনের আগে এই শহীদ ভাইদের হত্যার বিচারের রায় প্রয়োজন। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদীরা ঘাঁপটি মেরে আছে, তারা পাঁয়তারা করছে। ফ্যাসিবাদী দোসরদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের গ্রেফতার করতে হবে। বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

জুলাই শহীদ আলভির বাবা আবুল হাসান বলেন, আমার ছেলে শাহরিয়ার হাসান আলভি এই দেশের জন্য প্রাণ দিলো। কিন্তু এক বছরেও তার হত্যাকারীদের বিচার শুরু হলো না। বিচার নিয়ে টালবাহানা হচ্ছে। আপনারা বিচার নিয়ে আমাদের সঙ্গে টালবাহানা করবেন না। আবেগ আর বেদনার আবহে তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা জুলাই মাসের মধ্যেই ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করুন। দুই হাজার মায়ের বুক খালি হয়েছে, আর কতদিন বিচারহীনতা চলবে?

আবুল হাসান বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট মিরপুর-১০ নম্বরে গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় আমার ছেলে। আজ এক বছর পেরিয়ে গেল অথচ আমরা এখনো বিচারের ন্যূনতম আলোকরেখাও দেখতে পাচ্ছি না। হত্যাকা-ের মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেফতার করে নি। যারা হাসিনার আমলে পুলিশের চাকরিতে ছিল। তারা এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। তারা কীভাবে খুনিদের ধরবে?

তিনি বলেন, পুলিশকে বললে শুধু একটাই উত্তর। যাচ্ছি, যাবো। এ কেমন ব্যবস্থা? আমাদের সন্তানরা শহীদ হলো, আর আপনারা আমাদের সঙ্গে টালবাহানা করছেন!

বুয়েটে ছাত্রলীগের নৃশংস নির্যাতনে শহীদ আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ জানান, এখনো তিনি তার ছেলের হত্যার বিচার পাননি। তিনি বলেন, ৬ বছর হয়ে গেছে। ছেলে হত্যার বিচার এখনো পাইনি। আমি চাই, দ্রুত যেন আমার ছেলে হত্যার বিচার করা হয়। আবরার ফাহাদের বাবা বলেন, দেশের পক্ষে কথা বলার জন্য নির্মমভাবে নির্যাতন করে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। সেই বিচার এখনো হয়নি। হাসিনা সরকারের দমনপীড়নে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনে আহত কওমি শিক্ষার্থী রেদওয়ান নাবিল। কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জুলাই আন্দোলনের অবদানকে ছিনতাই করার যেকোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, যদি আমাদের অবদান জাতির সামনে তুলে ধরা না হয় এবং লুণ্ঠনের চেষ্টা করা হয়, তাহলে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটাতে পিছপা হব না।

রেদওয়ান নাবিল বলেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কওমি মাদরাসার ছাত্ররাও জুলাই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছিল। হাসিনা সরকারের দমনপীড়নে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও কোনো অংশে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিজে ১৮ জুলাই উত্তরা এলাকায় গুলীবিদ্ধ হয়েছিলাম, টিয়ার সেলে আমার চেহারা পুড়ে গিয়েছিল, তবুও আমরা পিছপা হইনি।

সংস্কারের নামে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন এখনও চালু রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধা তামিরুল মিল্লাত মাদরাসার শিক্ষার্থী জুনায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের শত শত শহীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখতে পেরেছি। গত বছরের ১৮ জুলাই আমি উত্তরায় স্নাইপার বুলেটে বিদ্ধ হই। যারা নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষকে শহীদ করেছে, তারা কোনোভাবে একটি রাজনৈতিক দল হতে পারে না। একটা সন্ত্রাসী দল দেশের রাজনীতিতে বিরাজ করুক, আমরা তা চাই না। আমরা চাই, জুলাইসহ সকল গণহত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।

তিনি আরও বলেন, সংস্কারের নামে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন এখনও চালু রয়েছে। ফ্যাসিবাদের শিকড় যতোই গভীরে থাকুক, তার মূলোৎপাটন না করা অব্দি আমাদের লড়াই চলমান থাকবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই, যেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে। কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকবে না, সকল দলের সমান সুযোগ ও অংশগ্রহণ থাকবে। আর এভাবেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবিত পিআর নির্বাচন জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে সক্ষম বলে মন্তব্য করেছেন জুলাই যোদ্ধা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এম এস মুস্তাফিজুর রহমান।

তিনি আরও বলেন, আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আল্লাহ উত্তম সাহায্যকারী, না হলে আমাদের একার কিছু করার নেই। তিনি আরও বলেন, এই ১৯ জুলাই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ইন্টারনেট নাকি এমনি এমনি বন্ধ হয়ে গেছে। সেসময় ফ্যাসিবাদী শিল্পপতিরা শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছিল, বলেছিল আন্দোলন দমনে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো। কিন্তু তারা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কারণ জালিমরা কখনও সফল হয় না।