খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা একের পর এক হলের তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষার্থীরা প্রেস ব্রিফিং করে ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবি জানিয়েছেন।

প্রেস ব্রিফিংয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, যেহেতু ভিসি কুয়েট শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, ব্যর্থতার দায় নিতে অস্বীকার করেছেন, তিনি ইন্টারনেট, পানি বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দিয়েছেন। ভিসি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলার ইন্ধন দিয়েছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেছেন তাই আমরা ছয় দফা থেকে এক দফা ঘোষণা করছি। এই ভিসিকে অপসারণ আমাদের একমাত্র দাবি। একই সাথে নতুন ভিসির অধীনে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। এর আগে সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে গত ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারির সহিংসতার ঘটনায় ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকা শিক্ষা কার্যক্রম আগামী ৪ মে এবং আবাসিক হলগুলো ২ মে খুলে দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেই প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। গত দুই দিন ধরে তারা প্রশাসনিক ভবনের সামনে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছিলেন।

মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষার্থীরা একের পর এক হলের গেটের তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করেন। হলের তালা ভাঙার আগে তারা বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষকদের কাছে হলের তালা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই হলের তালা খোলার সিদ্ধান্ত নেন।

শিক্ষার্থীরা বলেন, কুয়েটের সিন্ডিকেট সভায় যে ৩৭ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে কর্তৃপক্ষ তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি। কেন তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। কী অভিযোগে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তাও শিক্ষার্থীদের জানানো হয়নি।

হলের তালা ভাঙা শেষে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের ঘরে, আমাদের হলে আমরা প্রবেশ করেছি। হল খুলে দেয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করেছি প্রশাসনের কাছে। কিন্তু কাজ হয়নি। এখন আমরা প্রশাসনের কাছে আমাদের হলের বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা চালু করার জন্য দাবি জানাচ্ছি। নিরাপত্তা শাখার পক্ষ থেকে তাদের যদি নিরাপত্তা না দেয় আমরাই আমাদের হলের নিরাপত্তা ও নিজেদের নিরাপত্তা দেব। আমরা কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহার করব না। বাকবিতন্ডায় জড়াব না। একটা হলে আমরা রান্নার ব্যবস্থা করব। এ বিষয়ে রাতে আলোচনায় বসব। হলে আইডি কার্ড ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। কুয়েটের যেসব শিক্ষার্থী হলে থাকেন তাদের হলে আসার আহ্বান জানাই।

শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, আমরা শিগরিই ক্লাসে ফিরে যেতে চাই, আমাদের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে চাই। তবে নতুন ভিসির অধীনে।

উল্লেখ্য, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্রদল-যুবদলের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত হন। এ ঘটনার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য একাডেমিক কার্যক্রম ও হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গত রোববার বন্ধ থাকা কুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের জরুরী সভায় আগামী ২ মে আবাসিক হল এবং ৪ মে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেই প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। গত দুই দিন ধরে তারা প্রশাসনিক ভবনের সামনে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছিলেন। মঙ্গলবার দুপুর ১টায় বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের সামনে গিয়ে শিক্ষকদের তালা খুলে দেয়ার অনুরোধ জানাতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষকরা তাতে সাড়া দেননি।

এদিকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর দায়ের করা মামলার নিন্দা জানিয়ে ‘মার্চ ফর কুয়েট কর্মসূচি’র সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সোমবার দুপুরে গণমাধ্যমকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলেন, ‘প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যৌক্তিক দাবির পক্ষে আন্দোলন করার অধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ও সুরক্ষা নিশ্চিত থাকা উচিত। কিন্তু কুয়েট ভিসির প্রত্যক্ষ মদদে স্থানীয় একটি পক্ষকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রহসনমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে- যা গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী।’ তারা আরও বলেন, ‘কুয়েটের ভিসির পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশাসনিক অপব্যবহার ও দমননীতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়নের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে, তা একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রতিচ্ছবি। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলা চালানোর সময় সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও ভিসির স্পষ্ট অসহযোগিতা সেই উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দায় ভিসি এড়াতে পারেন না।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার হরণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলার আশ্রয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা শিক্ষার পরিবেশকে আরও সংকটময় করে তোলে। এই বাস্তবতায় ‘গঅজঈঐ ঋঙজ কটঊঞ’ কর্মসূচির প্রতি আমরা খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা পূর্ণ সংহতি ও সমর্থন জানাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার এবং নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা একাত্ম।’ যদি কুয়েট শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি দ্রুত মেনে নেয়া না হয়, তবে খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা সারাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একত্র হয়ে কুয়েট শিক্ষার্থীদের পক্ষে দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি ও কঠোর গণআন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে বলে বিবৃতিতে জানান শিক্ষার্থীরা।