একদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার-নাসরা রোগি সুস্থ করে তুলতে দিন-রাত পরিশ্রম করছে ; অপরদিকে পচাবাসি খাবার, টয়লেটের ময়লার উৎকট গন্ধ আর পানি সঙ্কটে সুস্থ হয়ে যাওয়া রোগিরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। রাতের বেলায় অধিকাংশ দিনই পানি থাকে না, বাথরুম অপরিষ্কার, বিভিন্ন ওয়ার্ডে বাথরুম রয়েছে অকেজো, হাসপাতালের বাউন্ডারীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ময়লার স্তূপ। এসব ময়লা থেকে উৎকট গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনরা। ৫০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও এখানে প্রতিদিনই রোগী ভর্তি থাকে দ্বিগুণেরও বেশি।
খুমেক হাসপাতালের নীচতলা দিয়ে যেখানেই যাবেন টয়লেটের সেপটিক ট্যাঙ্ক উপচে পড়া ময়লার গন্ধে আপনি নাকে রুমাল চেপেও দুর্গন্ধ এড়াতে পারবেন না। রোববার খুমেক হাসপাতালে বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়। খুমেক হাসপাতালের গাইনি ইউনিট-১। এটা হাসপাতালের নিচ তলায় অবস্থিত। হাসপাতালের উপর থেকে সব ধরনের উৎকৃষ্ট খাবার, ময়লা-আবর্জনা নিচে ফেলা হয়। এসব ময়লা হাসপাতালের বাইরে বাউন্ডারির মধ্যে ড্রেন ও আশপাশে জমে থাকে। সেখান থেকে বের হচ্ছে উৎকট গন্ধ।
ওই ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতালের উপর থেকে বিভিন্ন খাবারের অংশ, ময়লা, আবর্জনা নিচে ফেলা হয়। যার কারণে ময়লাগুলো সময় মতো পরিষ্কার না করায় উৎকট গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। জানালা খোলাতো দূরের কথা ওয়ার্ডের মধ্যে টিকে থাকাই দায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি ওয়ার্ডের একজন ইনচার্জ বলেন, উপর থেকে পচা তরকারি, ভাতসহ বিভিন্ন ময়লা নিচে ফেলা হয়। হাসপাতালের আসা রোগীর স্বজনরাই উপর থেকে এসব ময়লা ফেলে। ময়লা জমে থাকার কারণেই সব সময়ই গন্ধ ছড়াতে থাকে। দিনে একবার পরিষ্কার করে। এরপর আর পরিষ্কার করা চোখে পড়ে না। এছাড়া বাথরুমের বাইরে পাইপ নষ্ট থাকায় সেখান থেকে ময়লা এসে নিচে জমা হয়।
হাসপাতালে মেডিসিন ইউনিট-২ এর ওয়ার্ড (৭-৮) গিয়ে দেখা গেছে, পুরুষ ওয়ার্ডে তিনটি বাথরুমের মধ্যে দুটিই দীর্ঘদিন ব্লক হয়ে আছে। প্রায় এক মাস ধরে অধিকাংশ সময় রাতে পানি থাকে না। অপারেশন থিয়েটারগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ না হওয়ায় অপারেশনে বিঘœ ঘটছে। দিনের বেলায় দুই ঘন্টা পর্যন্ত ট্যাপে পানি থাকে। তারপর পানি শেষ। ডক্টরস বাথরুমে সিটকিনি নষ্ট। অধিকাংশই লাইট নষ্ট হয়ে আছে। বাথরুমের পরিবেশ নোংরাতে ভরা। বাথরুমে দরজার নিচের অংশ পচে অর্ধেক নেই।
এই ওয়ার্ডের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স নিপা মল্লিক জানান, বাথরুম পরিষ্কারের জন্য হারপিক, ভিক্সল ও গ্লিসারিন এই তিনটি জিনিসই অতি গুরুত্বপুর্ণ। কিন্তু এই তিনটি গত ৩-৪ মাস ধরে সংকট রয়েছে। গত ৩০ জানুয়ারি একটা হারপিক, ১টা ভিক্সল সরবরাহ করা হয়েছে। এরপর থেকে আর পাইনি। সাপ্লাই কম থাকায় এগুলো দিতে পারছেন না বলে আমাদেরকে জানায়। তিনি বলেন, দিনে দুই ঘণ্টার মতো পানি থাকলেও রাতের বেলায় অধিকাংশ সময়ই পানি থাকে না। ফলে রোগী ও রোগীর স্বজনরদের বেকায়দায় পড়তে হয়। বিশেষ করে রাতে যদি একটি হাসপাতালে পানি না থাকে তাহলে কি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওয়ার্ডে ৩-৪টা লাইট নষ্ট দীর্ঘদিন ধরে।
খুমেক হাসপাতালে গণপুর্ত বিভাগের (সিইও) সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালের দুইটি পাম্পের মধ্যে একটি পাম্প দীর্ঘ দিন ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় ওই মটর থেকে পানি উঠছে না। আরেকটা পানির পাম্প রয়েছে। ওই টা অপারেটর করা হয় আউটসোর্সিং কর্মী দিয়ে। ওয়াসার লাইন নেই। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে ওয়াসার লাইন নেয়ার জন্য। তিনি বলেন, একটা পাম্প দিয়ে তাও পানি দেওয়া সম্ভব কিন্তু ঠিকমত পানির পাম্প না চালানোর কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আগের আমাদের নিজস্ব পাম্প অপারেটর ছিলো। এখন সে না থাকায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। হাসপাতালের বাথরুম ও বাইরে ময়লা পাইপগুলো মেরামতের বিষয় জানতে চাইলে, তিনি বলেন বাজেট কম। তাই যেটুকু বাজেট আছে তা দিয়ে কাজ করছি। পর্যাপ্ত বাজেট থাকলে এই সমস্যা আর থাকবে না। মেডিসিন ইউনিট ৫-৬ এর ওয়ার্ডবয় আশরাফুল বলেন, এই ওয়ার্ডের ১৮টি ফ্যানের মধ্যে ১১টি নষ্ট। অধিকাংশ সময় রাতে পানি থাকে না। রোগীরা খুব কষ্ট পাচ্ছে।
হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মো. আনসার উদ্দিন বলেন, হারপিক, ভিক্সল, গ্লিসারিন যেটুকু সাপ্লাই আছে তা সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে সরবরাহ কম থাকায় চাহিদার তুলনায় দেয়া হচ্ছে না। হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোন রকম ম্যানেজ করে দিচ্ছেন। টেন্ডার পক্রিয়া শেষ হলেই এই সমস্যা আর থাকবে না।
এ ব্যাপারে খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহা. মহাসীন আলী ফরাজী বলেন, বাথরুম, পানির লাইনসহ বিভিন্ন সংস্কারের কাজগুলো করার দায়িত্ব পিডাব্লিউডি ও ওয়াসার কর্তৃপক্ষের। গত ৬ মাসে আমি হাসপাতালে পরিচালক হওয়ার পর থেকে তাদেরকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি। কিন্তু তারা দেখতিছি বলে, আর ওই সব কাজ মেরামত করছেন না। পিডাব্লিউডি সাব ইঞ্জিনিয়ারকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের যেসব জায়গা সমস্যা রয়েছে বা মেরামত করার প্রয়োজন সেগুলোও তাকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তারা যদি এসে কাজ না করে তাহলে আমরা কি করতে পাারি। এসব কাজ করার দায়িত্ব তাদের। আমাদের তো না। তারা বলছে, বাজেট কম তাই করতে একটু দেরি হচ্ছে। হাসপাতালে হারপিক, ভিক্সল, গ্লিসারিনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সরবরাহ কম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা নতুন করে টেন্ডারের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। আশাকরি এক সপ্তাহ এর মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলেই এ সমস্যা আর থাকবে না ইনশাআল্লাহ।