ফেনীতে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। কৃষি ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৭ লক্ষ টাকা, মৎস্য ক্ষেত্রে ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, প্রাণিসম্পদ ক্ষেত্রে ৬৫ লক্ষ টাকা, সড়কের ক্ষেত্রে ৯০ কোটি টাকা ও বাঁধ ভেঙে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতির পরিমাণ ৯ কোটি টাকা।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার বছর না পেরোতে ফের পানিতে ডুবেছে ফেনীর জনপদ। বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও ঘরে ফিরে নতুন সংকটে পড়েছেন ফেনীর দুর্গত এলাকার মানুষ। কর্দমাক্ত ঘরবাড়ি, ভাঙাচোরা আসবাবপত্র আর পঁচে যাওয়া খাদ্যসামগ্রী নিয়ে শুরু হয়েছে বেঁচে থাকার নতুন লড়াই। টানা বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা ও ফেনী সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল ও নদীতীরবর্তী এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। প্রবল পানির তোড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষক, মৎস্যজীবী ও গবাদিপশু পালনকারীরা।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বন্যাদুর্গত এলাকায় এবারও কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ছাড়িয়েছে ২৪৬ কোটি টাকা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবারের বন্যায় জেলায় আউশ ৮৪৫ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৫৩৭ হেক্টর, মরিচ ১৪ হেক্টর, আদা ৭ হেক্টর, হলুদ ২ দশমিক ৫ হেক্টর, টমেটো ০ দশমিক ১১ হেক্টর, আমন বীজতলা ৬৮৯ হেক্টর এবং বস্তায় সংরক্ষিত আদা ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টরসহ মোট ৫ হাজার ৫৬৪ দশমিক ৬১ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ২৮ হাজার ৮৩৫ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৭ লক্ষ টাকা।

এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ বলেন, এখনও অনেক এলাকায় পানি রয়েছে। বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র ও আর্থিক পরিমাণ নিরুপণ করা যাবে। আমরা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়ছি।

জেলা মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এখন পর্যন্ত ফেনী জেলায় মৎস্য খাতে ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। জেলার ছয়টি উপজেলায় ২ হাজার ৩৩০টি পুকুর, দিঘি ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে ২৭৬ দশমিক ২০ মেট্রিক টন মাছ। যার আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ ছাড়া, বন্যায় ১২৮ মেট্রিক টন পোনা মাছ ভেসে গেছে, যার আর্থিক মূল্য ৩ কোটি ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া খামারগুলোর বিভিন্ন অবকাঠামোতেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এতে ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির একটা প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতে কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে তালিকা পাঠানো হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, এবারের বন্যায় জেলায় মোট ১০ হাজার ৬০০টি মুরগি মারা গেছে। এর মধ্যে ফুলগাজীতে ১ হাজার ৪০০টি, পরশুরামে ৭ হাজার ২০০টি ও ছাগলনাইয়ায় ২ হাজার মুরগি মারা যায়। এ ছাড়া জেলায় বন্যায় ২৩৫টি হাঁস, ৩টি ছাগল, ১টি ভেড়া ও ৪টি গরু মারা গেছে। প্রাণিসম্পদের খাদ্যেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। পশুপাখির ৭ টন দানাদার খাদ্য নষ্ট হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। পাশাপাশি ৩০ টন খড় নষ্ট হয়েছে, যার মূল্য ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বিনষ্ট হয়েছে ১৬০ টন ঘাস, যার আনুমানিক মূল্য ৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে প্রাণিসম্পদে এবার মোট ৬৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫০ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বন্যায় জেলার প্রাণিসম্পদ খাত এবারও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য প্রাণিসম্পদে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫০ টাকা নিরূপণ করা হয়েছে। এ ক্ষতির চিত্র আরও বাড়তে পারে। দাপ্তরিকভাবে কোনো ধরনের প্রণোদনা বা সহায়তা বরাদ্দ হলে তা ক্ষতিগ্রস্ত খামারি ও প্রান্তিক খামারিদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে।

এর আগে গত মঙ্গলবার (৮ জুলাই) থেকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪১টি অংশের ভাঙনে বন্যাকবলিত হয় জেলার পাঁচটি উপজেলা। এতে প্রায় নয় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী আবুল কাশেম।

তিনি বলেন, এবার মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পরশুরামে ২২টি ও ফুলগাজীতে ১৯টিসহ মোট ৪১টি স্থানে ভেঙেছে।

ফেনী সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল ফারুক বলেন, চলতি বন্যায় ফেনীর তিনটি উপজেলায় ১২৬ টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার পরিমাণ ৩০০ কিলোমিটার , যা ৯০ কোটি টাকার সমমূল্য।

এখনও ৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১২২টি পরিবারের ৩৬৫ জন রয়েছে। ইতিমধ্যে ৯ হাজার ১৯৫ জন আশ্রয় কেন্দ্র ত্যাগ করে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছে।