তৌফিক রুবেল,দাউদকান্দি (কুমিল্লা): ভোরের কুয়াশা তখনো গা ভিজিয়ে রাখে দাউদকান্দির খেত-খাল। কেউ নৌকায় চড়ে, কেউ বা কোমরসমান পানিতে নেমে শাপলার ডাঁটা ছিঁড়ছেন। দিনের আলো ফোটার আগেই আঁটি বাঁধা শাপলা নিয়ে ছুটে চলা বাজারের পথে। এই শাপলাই এখন শতাধিক পরিবারের জীবিকার ভরসা, বর্ষা এলেই বদলে দেয় তাদের ভাগ্যের চাকা।
শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল, কিন্তু দাউদকান্দির মানুষের কাছে এটি শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়—এটি টিকে থাকার গল্প। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দাউদকান্দি, গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ, রায়পুর, জুরানপুর, সুন্দুলপুর, গোয়ালমারী, শ্রী রায়ের চর, বিটেরশ্বর, মলয় ও পালেরবাজারসহ আশপাশের গ্রামে শাপলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্ষা এলে কৃষিকাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তখন কৃষক পরিবারগুলো জীবিকার বিকল্প পথ হিসেবে শাপলা সংগ্রহে ঝুঁকে পড়েন।
প্রতিদিন বাজারে বিক্রি হয় অসংখ্য শাপলার আঁটি। প্রতিটি আঁটিতে থাকে ১৫-২০টি শাপলা, দাম মাত্র ১৫-২০ টাকা। যেখানে অন্যান্য সবজির দাম ৮০-১০০ টাকা, সেখানে শাপলার সাশ্রয়ী মূল্য নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস। শুধু তরকারি নয়, সরিষা ও নারকেল দিয়ে রান্না করা শাপলার ঝোল কিংবা ভাজিও গ্রামীণ রন্ধনশৈলীতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কেউ কেউ শাপলার মাথা শুকিয়ে খই তৈরি করেন, যা বাজারেও বিক্রি হয়।
শ্রী রায়ের চর গ্রামের আক্তার হোসেন ভোরবেলায় শাপলা তুলে বাজারে নিয়ে যান। তার কথায়, “প্রতিদিন যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে। সন্তানদের খাওয়ানো থেকে স্কুলের খরচ—সবই মেটে শাপলা বিক্রির টাকায়।”
শুকুর আলীর কণ্ঠেও মিশে আছে একই গল্পে আনন্দের সুর, “বর্ষার মৌসুম মানেই শাপলার সময়। প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার শাপলা বিক্রি করি। এই টাকায় সংসার চলে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হয়। তাদের মুখে হাসি দেখলেই মনে হয় শাপলাই আমার জীবনের রঙ।”
অনেকে বাজারে না গিয়ে মাথায় শাপলার আঁটি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করেন। এতে ক্রেতারা সহজে শাপলা পেয়ে যান, আর বিক্রেতারও আয় বাড়ে। ফলে এই গ্রামীণ সবজি প্রতিদিনই আরও বেশি মানুষের রান্নাঘরে জায়গা করে নিচ্ছে।
জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মতিন মনে করেন, শাপলা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, এটি জীবিকা ও জীববৈচিত্র্যের প্রতীক। তিনি বলেন, “শাপলা কোনো চাষ বা যত্ন ছাড়াই জন্মায়, এটি প্রকৃতির উপহার। কিন্তু মাটির উর্বরতা কমে গেলে বা কীটনাশক ব্যবহারের কারণে একদিন শাপলা হারিয়ে যেতে পারে। তাই শাপলা সংরক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।”
দাউদকান্দি উপজেলার সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “বর্ষায় অনেক পরিবার আয়ের উৎস হারায়। তখন শাপলাই তাদের ভরসা হয়। তবে অতিরিক্ত সংগ্রহ করলে জাতীয় ফুলের বীজ নষ্ট হতে পারে। সচেতনভাবে সংগ্রহ করতে হবে।”
শাপলার আঁটিতে তাই শুধু সবজি নয়, জড়িয়ে আছে গ্রামের মানুষের বেঁচে থাকার গল্প। বর্ষার কাদা মাখা মাঠে কিংবা খালপাড়ে শাপলার ডাঁটা ছিঁড়তে থাকা হাতগুলোতে লুকিয়ে থাকে সংগ্রামের ইতিহাস। সেই শাপলাই হয়ে ওঠে হাসি-খুশি সংসারের স্বপ্নের সেতু।