সরদার আবদুর রহমান: উত্তরের খাদ্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্রের বহুল আলোচিত ‘উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস ব্যবহার করে পৌনে ২ লাখ একরের বেশি (সাড়ে ৫ লাখ বিঘা) জমিতে সেচ প্রদানের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হওয়ার কথা। তবে বিতর্ক দেখা দিয়েছে পদ্মা নদী থেকে কোন পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করা হবে তা নিয়ে।

৩০ বছর আগে জাপানি কোম্পানি ‘জাইকা’ এই প্রকল্পের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। তবে অজ্ঞাত কারণে সেটি ফাইল চাপা পড়ে থাকে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নতুন করে এই প্রকল্প চাঙা করছে বলে জানা গেছে। এতে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি উত্তোলন করে সেচ খালের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেচ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য নদীতে প্রয়োজনীয় পাম্পিং স্টেশন এবং একটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এর ফলে প্রকল্প অঞ্চলে সেচের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে বলে পাউবো আশা করছে। প্রকল্পের সর্বশেষ পুনর্গঠিত ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৬২৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

বরেন্দ্র পরিস্থিতি

পাউবো’র মতে, শুষ্ক মওসুমে উচ্চ ও মাঝারি বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠের পানির পরিমাণ খুব কম থাকে। তাই প্রকল্প অঞ্চলে খরা প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত খুব দুষ্প্রাপ্য এবং বর্ষা-পূর্ব সময়কালে তা ২০০ মিলিমিটার অতিক্রম করে না। ফলস্বরূপ, বোরো ফসলের অনেক জমির জন্য বছরের বেশিরভাগ সময় প্রয়োজনীয় বৃষ্টির পানি পাওয়া যায় না। খরা দীর্ঘায়িত হলে বোরোর ফলন প্রায় অর্ধেক বা তার চেয়েও কম দাঁড়ায়। তবে টিউবওয়েলের মাধ্যমে দেয়া সেচ পর্যাপ্ত না হলেও পরিপূরক উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ করে। জাইকা’র এই কাজ ১৯৮৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন ১৯৮৮ সালের আগস্টে জমা দেয়। গবেষণায় মাঝারি ও নি¤œ বরেন্দ্র অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি পবা উপজেলার বন্যার সমতল অঞ্চলে পাম্প সাহায্যে সেচের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। এটি শেষ পর্যন্ত রাজশাহী জেলার পবা ছাড়িয়ে তানোর, গোদাগাড়ী এবং নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। প্রকল্প অনুযায়ী পদ্মা নদীর ভূ-উপরিস্থ পানি দিয়ে বরেন্দ্র এলাকার তিন জেলার ৯টি উপজেলায় সেচের পানি প্রদান, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নয়ন, মৎস্য চাষের উন্নয়ন তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে পদ্মাতীরবর্তী গোদাগাড়ীর মাটিকাটা রেল বাজারে পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হবে। অতঃপর সেখান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরায় বুস্টার পাম্পের মাধ্যমে সেচব্যবস্থা ছড়িয়ে যাবে। বর্তমানে বরেন্দ্র এলাকায় সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ফলে নতুন করে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে পাউবো’র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। সেসব দিক চিন্তা করেই এই প্রকল্প প্রণীত হয়েছে।

ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস বৃদ্ধি

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি জরিপ রিপোর্টে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর-পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা হয়, রাজশাহী জেলার তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলা, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার উপজেলা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায় বর্তমান ভূগর্ভস্থ পানির সংরক্ষণ অবস্থা খুবই ‘উদ্বেগজনক’। ফলে এই উপজেলাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমাবদ্ধ বা সীমিত করা জরুরি। বর্তমান পানির স্তর স্থির রাখাও উচিত হবে। এই এলাকায় বাড়তি পানির ব্যবহারের অনুমতি দেয়া উচিত হবে না। যেখানে পানির চাহিদা বেশি সেসব এলাকায় পানির চাহিদার ঘাটতি পূরণ করতে সম্ভব হলে কম চাহিদার এলাকা থেকে পানি সরবরাহের মাধ্যমে তা পূরণ করা যায়। এই পরিস্থিতি ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। পানির এই উৎস বৃদ্ধি করা এবং এগুলো সক্রিয় করার দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিশেষজ্ঞ অভিমত

এবিষয়ে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম. আসাদুজ্জামান বলেন, এধরনের উন্নয়নমূলক কাজ হতে তো কোনো সমস্যা নেই। বরেন্দ্রে সেচ বাড়বে, ফসলের উৎপাদন বাড়বে এটি ইতিবাচক। তবে সমস্যা হলো এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে। এখনকার কৃষক বা জমির মালিকরা তাদের জমির উপর দিয়ে খাল বা নালা কেটে পানি সরবরাহের পদ্ধতি পছন্দ করে না। এর বিকল্প হিসেবে বিদ্যমান রাস্তাগুলোর দুপাশের অংশ ব্যবহার করা যায়। আর জমির নিচে পাইপ বসিয়েÑ তা যে ডায়ামিটারেরই হোকÑ পানি নিয়ে গেলে জমি বেঁচে যায়। তিনি উল্লেখ করেন, এক সময় বরেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভালো ছিল বলে তা উত্তোলন করে সেচের কাজে লাগানো গেছে। কিন্তু এখন সেই স্তর আর অক্ষত নেই। ফলে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস বৃদ্ধি করে তা সেচের কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প সময়োপযোগীভাবে বাস্তবায়ন করলে তা কৃষকদের উপকারে আসবে বলে বিশিষ্ট এই কৃষি-প্রকৌশলবিদ আশা প্রকাশ করেন।