মোঃ রফিকুল ইসলাম, কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা) : সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ সংলগ্ন সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদ-নদী আর বিস্তীর্ণ চরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কেওড়া গাছ যেন উপকূলবাসীর জীবনে এক নীরব আশীর্বাদ। এই গাছের ফল ‘কেওড়া’, যা স্থানীয়ভাবে বুনো ফল হিসেবে পরিচিত হলেও বহু বছর ধরে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের খাদ্য, ওষুধ ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। ফল ও মৌসুমি আয় সাধারণত বর্ষা মৌসুমে কেওড়া গাছে ফল ধরে এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে তা সংগ্রহ করা হয়।

একটি পূর্ণবয়স্ক কেওড়া গাছ থেকে বছরে গড়ে ৪০৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়। বাজারে প্রতি কেজি ২০–৩০ টাকায় বিক্রি হয়, যা উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক দরিদ্র পরিবারের জন্য অতিরিক্ত আয়ের উৎস। ইতোমধ্যে এনজিওগুলোর প্রশিক্ষণে স্থানীয়রা ফল প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে। খাদ্য ও ঔষধি ব্যবহার কাঁচা অবস্থায় কেওড়া ফল খাওয়া যায় না। পরিপক্ব ফল সিদ্ধ, আচার বা চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়।

ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ এই ফল দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, হজমজনিত সমস্যা ও জ্বরের ঘরোয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও কেওড়ার উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাস ও প্রাচীন ব্যবহার বৈজ্ঞানিক নাম- চধহফধহঁং চধহফধহঁং ড়ফড়ৎরভবৎ ড়ফড়ৎরভবৎ-প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে বুনোভাবে জন্মানো কেওড়া মানুষের নিত্যজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেওড়ার পাতা দিয়ে ঘরবাড়ির ছাউনি, দড়ি ও মাদুর তৈরি হতো।

অন্যদিকে এর ফল ছিল মানুষ, মাছ ও বন্যপ্রাণীর অন্যতম খাদ্য। তবে শহর এলাকায় এই বনো ফল কেওড়া অনেকেই চিনত না। ফুল ও মধু সংগ্রহ কেওড়ার ফুল থেকে মৌমাছি সুগন্ধি ও ঔষধি গুণসম্পন্ন মধু সংগ্রহ করে। শত শত বছর ধরে সুন্দরবনের মৌয়ালরা এই মধুর ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য ও রপ্তানি সম্ভাবনা কেওড়া দিয়ে তৈরি আচার ও চাটনি দেশের ভেতরে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি ইতোমধ্যে বিদেশেও রপ্তানি শুরু হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

পরিবেশগত গুরুত্ব কেওড়া গাছ শুধু অর্থনৈতিক নয়, পরিবেশগতভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে প্রাকৃতিক বাঁধ হিসেবে কাজ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় কেওড়া কার্যকর প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাণীকুলের প্রধান খাদ্য কেওড়া ফল শুধু মানুষের জন্য নয়, বনের অসংখ্য প্রাণীর প্রধান খাদ্য। বানর, বর্ষা-শরতে দলবদ্ধভাবে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে খায়। এটি তাদের শক্তি ও পুষ্টি জোগায়। হরিণ-কেওড়া গাছের পাতা অন্যতম খাদ্য, গাছ থেকে পাকা ফল পড়ে গেলে হরিণ তা খেয়ে থাকে।

খাবারের সংকটে এটি তাদের বিকল্প খাদ্য। মাছ-গাছ থেকে নদীতে ঝরে পড়া ফল ধীরে ধীরে জলে মিশে যায় এবং মাছের খাদ্য হিসেবে কাজ করে। এটি মাছের বৃদ্ধি ও প্রজননে সহায়ক। পরিবেশবিদদের মতে, অবৈধভাবে গাছ কাটা ও বন ধ্বংস কেওড়ার বিস্তারে বড় হুমকি। বন বিভাগও স্থানীয়দের সচেতন করছে যাতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ফল সংগ্রহ হয় এবং গাছ রক্ষা পায়।

বর্তমান অনেকেই লোকালয়ে নদীর কিনারায় সামাজিক বনায়ন মাধ্যমে কেওড়া গাছ লাগিয়ে ভাঙ্গন রোধে এবং কেওড়া বিক্রি করে অনেকেই জীবন জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। সুন্দরবনের বুনো ফল কেওড়া শুধু খাদ্য বা আয়ের উৎস নয়, বরং প্রাণীকুলের টিকে থাকার অন্যতম ভরসা। তাই কেওড়া সংরক্ষণ মানে শুধু বন রক্ষা নয়, পুরো জীববৈচিত্র্যের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।