বিশেষ প্রতিনিধি, রাজশাহী: একদা পদ্মার বিপুল পানিপ্রবাহকে কেন্দ্র করে যে জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছিল, ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় গত অর্ধ শত বছরে তা প্রায় লুপ্ত হওয়ার পথে ছিল; কিন্তু এখন বিস্ময়করভাবে পানির সংকীর্ণ ধারা এবং বিস্তীর্ণ চর ও বৃক্ষসারিকে কেন্দ্র করে সেই বৈচিত্র্য ফিরতে শুরু করেছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ফারাক্কাসহ উজানে বহু প্রতিবন্ধকতার কারণে পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ শীর্ণ দশায় পতিত হয়েছে গত কয়েক দশকে। এর ফলে কৃষি, সেচ, নৌ-চলাচল ও মৎস্য সম্পদ আহরণ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিপন্ন হয়েছে জীববৈচিত্র্যও। বিস্তৃত হয়েছে নদীর চর। এই সঙ্গে পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ অর্ধশতাধিক নদী ভরাট হয়ে গেছে। খাল-বিলের তলদেশ আবাদী জমিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও বাঁধ ও রেগুলেটরের প্রতিবন্ধকতায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জলাভূমির খাদ্য-শৃঙ্খল তথা ফুড চেইনের অন্তর্ভুক্ত প্রাণীকুল ধ্বংস প্রায়। জলাশয় নির্ভর পক্ষী শ্রেণির বক, মাছরাঙ্গা, ডাহুক, সারস, বৃহৎ পানকৌড়ি, মদনটেক, কোদালীবক, নীলশির হাঁস, পান্তামুখী হাঁস, বুটি হাঁস, চীনা বক, গগনভের, মানিকজোড় প্রভৃতি হারিয়ে গেছে। অন্যান্য জলচর প্রাণির মধ্যে ঘড়িয়াল, তিমির, গাঙের শুশুক, কচ্ছপ, কোলাব্যাঙ, জলডোয়া, মেছোবিড়াল, ভোদড়, সংকোচ প্রভৃতি প্রায় হারিয়ে গেছে। পদ্মার ঘড়িয়ালের অস্তিত্ব পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ায় এবং জেলেদের হাতে পড়ে নিঃশেষ হওয়ার পথে। পদ্মার ঘড়িয়ালের দুই বংশধর এখন রাজশাহী চিড়িয়াখানায় শোভা পায়। জলাশয়গুলো হারিয়ে যাবার ফলে এবং শিকারীদের অত্যাচারে যাযাবর পাখির আগমন বন্ধ হয়ে যায়। এই অঞ্চল থেকে অন্তত ৪০টি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ফারাক্কার কারণে প্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যাবার ফলে সমুদ্রের ইলিশের এই অঞ্চলে আগমনও মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই পদ্মা নদী যেন আবার ফিরে পাচ্ছে নিজের পুরনো রূপ, এক সময় যে নদীর বুক ছিল প্রাণে ভরপুর, সেই পদ্মার নদীতে আবার দেখা মিলছে জীবনের চিহ্ন। পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃতি কখনো বসে থাকে না। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়। তারই উদাহরণ বর্তমান পদ্মা নদীকেন্দ্রিক প্রকৃতি। ফারাক্কা বাঁধের উজানেও ভারতীয় অংশে নতুন ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে বলে জানা গেছে। তবে সেটি হয়েছে ইতিবাচক পরিবেশে। আর বাংলাদেশে হয়েছে নেতিবাচক অবস্থায়। এপারের নদীতে পানির প্রবাহ ও বিস্তার হ্রাস পেলেও তাকে কেন্দ্র করেই নতুন জীববৈচিত্র্য সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। পদ্মা নদীর দুপাড়ে দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যে যে গাছপালা-বৃক্ষরাজির সম্প্রসারণ ঘটেছে তাকে কেন্দ্র করে জলাশয়কেন্দ্রিক পাখির বিপুল আনাগোনা বেড়েছে। অতিথি ও যাযাবর পাখিদের আগমন ঘটছে। শিকারীদের দাপট কমে যাওয়ায় তারা নির্ভয়ে চলাচল করতে পারছে। বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে মানবিক কর্মকাণ্ড, নদীভাঙন আর দূষণে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল এই নদীর বুকে প্রাণের ছোঁয়া। কিন্তু এবার পদ্মা যেন নিজেই নিজের পুনর্জন্মের আয়োজন করেছে। তীরে বসে থাকা জেলে বা পথচলার মাঝখানে থেমে যাওয়া মানুষদের চোখে ফুটে উঠছে বিস্ময়।

সাম্প্রতিক কালে এই নদীতে দেখা মিলেছে বিরল প্রজাতির পাখি ‘কমন মার্গেঞ্জার’ এবং কুমিরের উপস্থিতি, যা নদীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্যের ইতিবাচক বার্তা বহন করে। পরিবেশবিদদের মতে, এ ধরনের প্রাণীর উপস্থিতি প্রমাণ করে পদ্মা এখনো প্রাণে ভরপুর এবং জীববৈচিত্র্যের একটি সম্ভাবনাময় আশ্রয়স্থল। এই বিরল প্রজাতিগুলোর উপস্থিতি শুধুই আকর্ষণীয় নয়, বরং নদী রক্ষায় নতুন করে ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে।

পাখিদের কলতানে এখন মুখর রাজশাহীর পদ্মা। বাংলাদেশে দেখা যায় না বললেই চলে এমন দুর্লভ পাখির দেখা মিলেছে পদ্মার চরে। পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর এ হাঁসকে রাজশাহীর পদ্মায় প্রথমবারের মতো দেখা গেছে। বিরল প্রজাতির ‘বৈকাল তিলিহাঁস’ পাখিরও দেখা মিলেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) সম্প্রতি রাজশাহীর পদ্মা নদীর ৩৯ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাখিশুমারি করে। আইইউসিএন বাংলাদেশের ওয়াইন্ড বার্ড মনিটরিং প্রোগ্রামের আওতায় করা এ শুমারিতে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, রাজশাহী বার্ড ক্লাব এবং বন অধিদপ্তর। তথ্য মতে, শুমারিতে পদ্মার পাড়জুড়ে ৩৭ প্রজাতির মোট ৪ হাজার ২৫টি পাখি গণনা করা হয়। এর মধ্যে আছে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০০টি পাওয়া গেছে পিয়ং হাঁস। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিংয়ের চা পাখি। এছাড়া দেশি মেটে হাঁস, লালমাথা ভূতিহাঁস, ইউরেশিয় সিথিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, কালা মানিকজোড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আইইউসিএনের গবেষকরা জানিয়েছেন, পদ্মারচরে অনেক দুর্লভ প্রজাতির পাখি পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে একাধিক কুমিরের দেখা মিলেছে। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক একটি কুমির ও ছোট কুমির দেখেছেন স্থানীয় জেলেরা। এ অবস্থায় নদীতে গোসল না করতে এলাকাবাসীকে মাইকিং ও লিফলেটের মাধ্যমে সতর্ক করছে রাজশাহী বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। ২০১৫ সালে মিঠাপানির কুমির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরে পাবনা ও আরো দুটি স্থানে কুমির দেখা যায়, যেগুলো এখন সুন্দরবনের করমজল প্রজননকেন্দ্রে সংরক্ষিত। ধারণা করা হচ্ছে, রাজশাহীর কুমিরটি সম্ভবত ভারতের চাম্বুল নদ এলাকা থেকে এসেছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মায় একাধিক কুমির রয়েছে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ঘড়িয়ালের বাচ্চাও মিলেছে জেলেদের জালে। কিছুদিন আগে মিঠা পানির ডলফিন বা স্থানীয় জাতের গাঙ্গেয় শুশক মৃত অবস্থায় চরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। হারিয়ে যাওয়া দেশি জাতের নানাপ্রকার মাছও পাওয়া যাচ্ছে জেলেদের জালে। পদ্মার চরগুলোর অনেক স্থানেই নানা ধরণের ফল-ফসলের আবাদ বেশ জোরদার। এই আবাদী জমিও প্রাণের বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সহায়ক হচ্ছে বলেও মনে করা হচ্ছে।