আন্তর্জাতিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করে বলেছে, ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার ফিলিস্তিনীদের অনাহারে রাখছে। গতকাল সোমবার ফরাসি গণমাধ্যম এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। এএফপি, গার্ডিয়ান, রয়টার্স
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসা প্রদানকারী চিকিৎসা কর্মীদের উদ্ধৃতি করে এ অভিযোগ করেছে অ্যামনেস্টি।
ইসরাইল গাজা উপত্যকায় সাহায্যের অনুমোদন কঠোরভাবে সীমিত করেছে। গত ২২ মাস ধরে চলা যুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে থাকার দাবি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে।
এএফপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে, সামরিক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অ্যামনেস্টির অনুসন্ধানের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, ‘ইসরাইল অধিকৃত গাজা উপত্যকায় ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখার জন্য অভিযান চালাচ্ছে, যা ফিলিস্তিনিদের স্বাস্থ্য, কল্যাণ এবং সামাজিক কাঠামোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে।’
গাজায় একদিনে ইসরাইলী হামলায় নিহত ৪৭, অনাহারে মৃত্যু ৭
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলী হামলায় কমপক্ষে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া এ সময়ে ইসরাইলী অবরোধের ফলে সৃষ্ট অনাহারে আরও ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত রোববার ফিলিস্তিনী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধে কমপক্ষে ৬১ হাজার ৯৪৪ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় ৪৭টি মৃতদেহ হাসপাতালে আনা হয়েছে এবং ২২৬ জন আহত হয়েছেন। যার ফলে ইসরাইল হামলায় আহতের সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতে না পারায় অনেক ভুক্তভোগী এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন। ‘
মন্ত্রণালয় আরও উল্লেখ করেছে, গত ২৪ ঘন্টায় মানবিক সাহায্য নিতে গিয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১৩২ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। যার ফলে গত ২৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত সাহায্য নিতে গিয়ে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ১ হাজার ৯৩৮ জনে দাঁড়িয়েছে এবং আরও ১৪ হাজার ৪২০ জন আহত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় উপত্যকায় অপুষ্টি ও অনাহারে আরও সাতজন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। এর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ২৫৮ জনে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে ১১০ জন শিশু।
গত ২ মার্চ থেকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ গাজার সব সীমান্ত ক্রসিং সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। যার ফলে অঞ্চলটিতে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভূখ-ে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের যোদ্ধারা। এদিন ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যার পাশাপাশি ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় তারা।
হামাসের হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অভিযান চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যস্থতাকারী অন্যান্য দেশগুলোর চাপে বাধ্য হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
কিন্তু বিরতির দু’মাস শেষ হওয়ার আগেই গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ।
এছাড়া গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পাশাপাশি উপত্যকাটিতে আগ্রাসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখিও রয়েছে ইসরাইল।
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন প্রস্তাব পেয়েছে হামাস: ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা
কায়রোতে অবস্থানরত হামাসের আলোচকরা গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি নতুন প্রস্তাব পেয়েছেন। এ প্রস্তাবে প্রাথমিকভাবে ৬০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি এবং দুই ধাপে জিম্মি মুক্তির পরিকল্পনা রাখা হয়েছে।
গতকাল সোমবার ফিলিস্তিনের এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, এই প্রস্তাবটি একটি কাঠামোগত চুক্তি, যা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার সূচনা করবে।
তিনি আরও বলেন, মধ্যস্থতাকারীদের দেওয়া এই প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য হামাস তাদের নেতাদের সঙ্গে এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করবে।
গত সপ্তাহে হামাস জানায়, তাদের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল কায়রোতে রয়েছে, যারা গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মিসরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছে। গাজা যুদ্ধ এখন ২৩তম মাসে প্রবেশ করেছে।
কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মিসরও ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতায় জড়িত। তবে এ বছরের শুরুর দিকে স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধবিরতির পর থেকে পরববর্তী পদক্ষেপ নিয়ে এখনও কোনও অগ্রগতি হয়নি।
মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি সোমবার গাজার রাফাহ সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, আমরা যখন এখানে কথা বলছি, তখন ফিলিস্তিনি ও কাতারি প্রতিনিধিরা মিসরে অবস্থান করছেন এবং তারা পদ্ধতিগত হত্যাকা- ও অনাহার বন্ধে প্রচেষ্টা জোরদার করছেন।
গত সপ্তাহে আবদেলাত্তি বলেন, কায়রো কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি করার জন্য কাজ করছে, যার আওতায় ‘কিছু জিম্মি এবং কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং কোনও বাধা ছাড়া গাজায় মানবিক ও চিকিৎসা সহায়তা চালু হবে।
গত মাসে কাতারের রাজধানী দোহায় টানা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা আলোচনায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনও অগ্রগতি হয়নি।
জিম্মি মুক্তি ও গাজা যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইসরাইলজুড়ে বিক্ষোভ
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও উপত্যকাটিতে আটক জিম্মিদের মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভে নেমেছেন ইসরাইলিরা। গতকাল রোববার গাজায় আটক জিম্মিদের পরিবারের সমর্থনে দেশব্যাপী এ বিক্ষোভে অংশ নেয় হাজার হাজার ইসরাইলি নাগরিক। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা ইসরাইলি পতাকা উড়িয়ে এবং জিম্মিদের ছবি বহন করে, সারা দেশে সমাবেশে বাঁশি, হর্ন এবং ঢোল বাজিয়ে বিক্ষোভ করে। এর মধ্যে কিছু বিক্ষোভকারী জেরুজালেম এবং তেল আবিবের মধ্যকার প্রধান রুট সহ রাস্তা এবং মহাসড়ক অবরোধ করে।
গাজায় হামাসের হাতে বন্দি মাতান অ্যাংরেস্টের মা আনাত অ্যাংরেস্ট তেল আবিবের একটি পাবলিক স্কোয়ারে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ জীবনের সবকিছুর মূল্য স্মরণ করতে গিয়ে যেন সবকিছু থেমে গেছে।’
তেল আবিবে জিম্মিদের পরিবারের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ইসরাইলি হলিউড অভিনেত্রী গ্যাল গ্যাদত, যিনি ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ চরিত্রের জন জনপ্রিয়। এছাড়া তিনি জনপ্রিয় ফাস্ট অ্যান্ড দ্য ফিউরিয়াস ফ্র্যাঞ্চাইজিতেও অভিনয় করেছেন।
এর আগে ইসরাইলের কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠান জানায়, তারা তাদের কর্মীদের দেশব্যাপী ধর্মঘটে যোগদানের অনুমতি দেবে। এর ফলে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও দেশজুড়ে অনেক প্রতিষ্ঠানই খোলা ছিল। আর স্কুলগুলো গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে থাকায় এতে কোনও প্রভাব পড়েনি।
ইসরাইলি পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় সময় দুপুর ২টা নাগাদ ৩৮ জন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। রাস্তা অবরোধকারী কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে এবং অফিসাররা তাদের ধরে নিয়ে যায়।
এদিকে স্থানীয় সময় বিকাল ৪টার দিকে তেল আবিব, জেরুজালেম এবং অন্যান্য স্থানে বিমান হামলার সাইরেন বাজলে ইসরাইলজুড়ে বিক্ষোভ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। সাইরেনগুলো ইয়েমেন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আগমনের সতর্কীকরণের জন্য বাজানো হয়। তবে কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রতিহত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরাইলী সামরিক বাহিনী।