প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, জুলাই বিপ্লব সংবিধান বাতিলের কথা বলেনি। বরং জনজীবনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সাড়া দেওয়ার মানসিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবিধানের সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ‘ সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত 'বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন, বাংলাদেশ’-শীর্ষক সেমিনারে উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশকে তার সাংবিধানিক জীবনের ব্যাকরণ পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। এটি রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, আইনের শাসন কোনো আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতি বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অলংকার নয়। বরং আইনের শাসন হলো-সাংবিধানিক ব্যবস্থার একটি নৈতিক পাঠ, যা ন্যায্যতা, যুক্তি এবং জনগণের সম্মতির ওপর ভিত্তি করে। এটি অধিকারের মাধ্যমে, সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে, শাসিতদের যে মর্যাদা প্রদান করে তার মাধ্যমে এর দিকে ইঙ্গিত করে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, জুলাই বিপ্লব সংবিধান বাতিলের কথা বলে নাই, বরং এটি সংবিধানের প্রতি আমাদের আনুগত্য ও দায়িত্ববোধকে শুদ্ধ করার আহ্বান জানিছে। ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং অতীতের কাটা-ছেঁড়ার পরও বর্তমান সংবিধানই বিচার বিভাগের বৈধতার বাতিঘর।
প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের জন্য তার ঘোষিত রোডম্যাপের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সংস্কার রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়। এটি জাতীয় আকাক্সক্ষাকে কাঠামো দেওয়ার প্রচেষ্টা। রোডম্যাপে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথককরণের বিষয়ে বিশদভাবে তুলে ধরেছিলেন। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে অভূতপূর্ব বিচারিক রোডশোর একটি ধারাবাহিকতায় রোডম্যাপ অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত করছি। বিচারক নিয়োগে বিধান প্রণয়নসহ ইতোমধ্যে নেয়া পদক্ষেপ তুলে ধরেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার গুরুত্ব তুলে ধরেন। বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ জারিসহ অন্যান্য পদক্ষেপের কথা তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন মন্তব্য করেছেন বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশ নিজেকে একটি সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ‘প্লেয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পুনর্গঠনের সময় অনেক রাষ্ট্র পক্ষ বেছে নিতে আগ্রহী হয়, কিন্তু আমাদের উচিত প্রথমে সঠিক পথ বেছে নেওয়া। বঙ্গোপসাগর এখন কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সেখানে বাংলাদেশ নিছক কোনো করিডোর হয়ে থাকতে চায় না, বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কৌশলগত ভূমিকা রাখতে চায়।
তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ নিজেকে একটি সক্রিয়, সার্বভৌম ও দায়িত্বশীল প্লেয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে জড়িত থাকব। প্রয়োজনে দৃঢ়ভাবে কথা বলব এবং জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিকে নজর রেখে সর্বদা উৎপাদনশীল অংশীদার হবো।
তিনি বলেন, ক্ষমতার জ্যামিতিতে যারা থাকবেন, তারা বড় ও মধ্যবিত্ত শক্তির সঙ্গে সমানভাবে সম্পৃক্ত হবেন। তবে, তাদের সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌম সমতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে।
উপদেষ্টা বলেন, আমার দেশ ভঙ্গুরতার মূল্য জানে, আমরা মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের দরজা খুলে দিয়েছি। আমরা জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অবদান রেখেছি এবং আমরা জানি মানবিক সংকট কত দ্রুত বাড়তে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গে মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। উপকূলীয় দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করে প্রযুক্তি ভাগাভাগি ও জলবায়ু-সহনশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিজিএসর সভাপতি জিল্লুর রহমান এবং সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী।