আহসানুল হক জুয়েল, নিকলী (কিশোরগঞ্জ) হাওড় অঞ্চল থেকে : কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড়াঞ্চলসহ সারা জেলায় বোরো ধান কাটার ধুম লেগেছে। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাক্সিক্ষত সোনালী ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন হাওড় অঞ্চল সহ জেলার কৃষাণ-কৃষাণীরা।

কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ১ লক্ষ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে। এর মাঝে শুধু হাওড়েই ১ লক্ষ ৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। যেখান থেকে উৎপাদিত চালের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লক্ষ ৮৮ হাজার ৯১২ মেট্রিকটন এবং ধানের উৎপাদন ধরা হয়েছে ১১ লক্ষ ৮৩ হাজার ৩৬৮ মেট্রিকটন। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১২০০ টাকা প্রতি মণ তবে এবার তা কৃষকদের জন্য বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪৪০ টাকা প্রতিমণ। যা প্রতি কেজি ৩৬টাকা। সরকার এ বছর কৃষকদের কাছ থেকে ৩৯ টাকা কেজি দরে ধান ও ৪৮ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করবে বলে জানা গেছে।

জেলার হাওড়াঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, খরচ ও ঋণ মেটাতে অনেক চাষি ধান ঘরে না তুলেই বিক্রি করে দিচ্ছেন ৮২০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে। যদিও এক মণ বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত। ফলে কৃষকের মুখে হাসি মলীন হয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় উপজেলা গুলো হলো নিকলী ইটনা মিঠামইন অষ্টগ্রাম উপজেলা। এই চারটি উপজেলা ছাড়াও বাজিতপুর কুলিয়ারচর এবং করিমগঞ্জ উপজেলা কিছু অংশ নিয়ে জেলার হাওড়াঞ্চল। ইতিমধ্যেই হাওড়াঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ বোরো ধান ইতিমধ্যেই কৃষকরা গড়ে তুলেছেন বলে একটা সূত্র দাবি করেছে। বাকি ৪০ ভাগ বোরো ধান আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই কৃষকের ঘরে তোলা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। যদি কোন প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড় শিলাবৃষ্টি এবং উজান হতে হঠাৎ কোন পানি না আসে। উল্লেখ্য হাওড়াঞ্চলের মানুষের একমাত্র খাদ্য ফসল এই ধান। জমিগুলো সবই এক ফসলি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্ত হলে হাওড়াঞ্চলের কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে যাবে। কৃষকরা এই সংবাদদাতা কে জানান মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী থাকলে এ বছর বোরো ফসল খুব সুন্দরভাবেই ঘরে তুলতে পারবেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আগাম পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ফসল হানি রোধে এবার কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চলে উপজেলায় ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ১২৯টি ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

নিকলী উপজেলার সবচেয়ে বড় হাওড় জনশাইয় হাওড়ে কৃষক কিতাব আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ২ একর বোরো ২৮ জাতের ধান কাটতেছি। ফলন ভালো হয়েছে। তবে ধান কাটার মৌসুমি কৃষি শ্রমিকের সংকট রয়েছে এলাকায়। তাই পরিবারে লোকজন ও এলাকার শ্রমিকদের নিয়ে ধান কাটতেছি। ধানের ন্যায্য মূল্য পেলে আমরা লাভবান হবো। জমি আবাদ করতে গিয়ে ঋণ করতে হয়েছে। তবে ভালোয় ভালোয় ধান তুলতে পারলে সব ঋণ শোধ করা যাবে। বর্তমানে হাওড়া অঞ্চলে ধান কাটার শ্রমিক মজুরি চলছে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা করে। অনেক কৃষক নিরুপায় হয়ে উচ্চ মূল্যের শ্রমিক এনে তাদের সোনালী ফসল ঘড়ে তুলছেন।

নিকলীর আলিয়া পাড়া গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন বলেন, আমরা কৃষক মানুষ ঋণ করে বোরো ধান করেছি। ধানের ফলন ভালো হয়েছে এখন দাম ভালো পেলে লাভবান হবো। না হলে ঋণের বোঝ বইতে হবে।

হাওড়ের নোয়াপাড়া কৃষক পাপ্পু মিয়া বলেন, আমাদের হাওড়ে হাইব্রিড ছক্কা, ফাইজং ও হাইব্রিড ২৯ ধানের ভালো ফলন হয়েছে। শুনেছি হাওড়ে বাঁধ হয়েছে। তাই বন্যা হওয়ার শঙ্কা কম। কষ্টের ফসল নষ্ট হলে কি যে কষ্ট এইটা বইলা বোঝাইতাম পারতাম না। এখন হাওড়ের দিকে ছাইয়া ছাইয়া দুই হাত তুইলা মহান আল্লাহতালার কাছে দোয়া করি, যে ধান জমিতে আছে সেই ধানের যাতে কোনো ক্ষতি না অয়।’ এই আকাক্সক্ষা শুধু আমার একার নয়, পুরো হাওড় অঞ্চল বাসীর।

নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর থেকে ১০ জনের একটি শ্রমিকের দল নিয়ে এসেছেন আমিন উদ্দিন নামের শ্রমিক দলনেতা। তিনি জানান, গত বছর শ্রমিকের মূল্য বেশি ছিল এবার কিছুটা কম। হাওড়ে এখন মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটা হয় তাই আমাদের মূল্য কম।

হার্ভেস্টার মেশিনের মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে অনেক সময় লাগে। হার্ভেস্টার মেশিন দিয়ে ১ একর জমির ধান কাটতে মাত্র ১ ঘণ্টা লাগে। মেশিনে ধান কেটে কৃষক সহজেই বাড়ি নিয়ে যেতে পারে।

কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ি) উপপরিচালক ড. মোঃ সাদিকুর রহমান জানান, খাদ্যে উদ্বৃত্ত কিশোরগঞ্জ জেলায় চলতি বছর ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ লাখ ৮৮ হাজার ২১০ টন। আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে। এ বছর সরকারিভাবে নির্বাচিত কৃষকদের কাছ থেকে ৩৯ টাকা কেজি দরে ধান ও ৪৮ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করা হবে।

জেলার হাওড়াঞ্চলে কৃষি শ্রমিক সংকট কাটাতে হাওড়ে ইতিমধ্যে ২২০টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিন ধান কাটার কাজ করছে। এছাড়া প্রতিদিনই বাহিরের জেলা থেকে হার্ভেস্টার মেশিন আসছে। পাশাপাশি কৃষি শ্রমিকরাও ধান কাটায় ব্যস্ত রয়েছে।