চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে বলে জানিয়েছেন সাবেক এমপি ও চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমীর শাহজাহান চৌধুরী। গতকাল রোববার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। এনসিটি বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার দাবিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামী।

চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমীর শাহজাহান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। এই বন্দরের মাধ্যমে দেশের আমদানি ও রপ্তানির ৯২শতাংশ কাজ হয়ে থাকে। আমরা মনে করি, চট্টগ্রাম বন্দর শুধুমাত্র অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র নয়, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সাথেও সংশ্লিষ্ট। তাছাড়া, বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক বন্দর খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) একটি আধুনিক টার্মিনাল হিসাবে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০১ সালে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নির্মাণ কাজ শুরু করে। এতে ১ হাজার মিটার দীর্ঘ বার্থ রয়েছে যেখানে একই সাথে পাঁচটি জাহাজের মালামাল উঠানামার কাজ করতে পারে এবং ব্যাকআপ ফ্যাসিলিটিজ হিসাবে রয়েছে ২৬ হেক্টর জায়গার উপর উন্নত প্রযুক্তি সম্বলিত ইয়ার্ড। বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কন্টেইনার টার্মিনাল হিসেবে এনসিটি টার্মিনাল বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়া, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল আয় আসে এই এনসিটি টার্মিনাল হতে। গত অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪) এনসিটি থেকে আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ আয়ের পাশাপাশি রেকর্ড সংখ্যক কন্টেইনার হ্যাল্ডলিং হয়েছে যা পূর্বের বছরের তুলনায় ৭.৩৭ শতাংশ বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের মোট হ্যাল্ডলিংয়ের ৫৫ শতাংশ এনসিটি টার্মিনালে হয়।

সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, যা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসাবে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের এই নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) চালু হওয়ার পর এই টার্মিনালকে আধুনিক টার্মিনালে রূপান্তরিত করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক ও উন্নতমানের নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয় করে। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এই টার্মিনালে কোনো প্রকার বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই এবং টার্মিনালটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই টার্মিনালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর বিশাল রাজস্ব আয় করছে।

“এনসিটি টার্মিনালের ধারণ ক্ষমতা ১.১ মিলিয়ন টিইইউএস। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দক্ষতার ফলে এই টার্মিনালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। বর্তমানে বন্দরের এই টার্মিনালে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ৪০০০-৫০০০ দক্ষ কর্মকর্তা ও দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী ৪ ঘণ্টা কাজ করে এবং তার সাথে রয়েছে শত শত স্টেকহোল্ডার ও তাদের কর্মচারীবৃন্দ। এদের প্রত্যেকের সাথে এক একটি পরিবার জড়িত।”

তিনি বলেন, বর্তমানে এই চালু টার্মিনাল নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আপনারা জানেন, বিগত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কু-নজর পড়ে এই চালুকৃত ও রাজস্ব খাতের মূল চালিকাশক্তি এনসিটি টার্মিনালের ওপর। দেশের অন্যতম অর্থ পাচারকারী ও শেখ পরিবারের প্রধান অর্থ যোগানদাতা সালমান এফ রহমান ব্যাংকসহ দেশের লাভজনক সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে সর্বশেষ এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

“যেই পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরিকৃত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল দিয়ে দেয়া হয়েছে, সেই একই পদ্ধতিতে এনসিটি টার্মিনালও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত চলছে। যদি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থান না হতো, তাহলে এতদিনে এই এনসিটি টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে চলে যেত। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকার পালিয়ে গেলেও সরকারের বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন, বর্তমান সরকারকে বিভ্রান্তিমূলক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে দেশের রাজস্ব খাত শেষ করার জন্য এবং দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানার জন্য এনসিটি টার্মিনালকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।”

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশিদের হাতে দেয়া হলে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কি কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তার কিছু নমুনা তুলে ধরে তিনি বলেন, সর্বপ্রথম ট্যারিফ নির্ধারিত থাকায় সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মূদ্রা হতে বঞ্চিত হবে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে আঘাত হানবে। এছাড়া, দেশের অর্থনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। এনসিটিতে নিযুক্ত চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ওই টার্মিনালে কর্মরত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ চাকরিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা বৈধভাবে বিদেশে চলে যাবে (বর্তমান আয়ের ৫০শতাংশ)।

“৫০০০ কোটি টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসমূহ হস্থান্তরে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষতি হবে ৪ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরের স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিবে। বৈদেশিক বাজারে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। বর্তমান কর্মরত দক্ষ শ্রমিকদের মাঝে হতাশা বাড়বে তাদের জীবনমান নি¤œমুখী হবে। অবসর জীবনের অনিশ্চয়তা ও দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পাবে। ৫৫ শতাংশ আমদানি রপ্তানি এনসিটি টার্মিনাল দিয়ে হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর তথা বাংলাদেশের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় যে কোন সময় চ্যালেঞ্জ তৈরি হলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। এই টার্মিনালের পাশে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত। যা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ও গোপনীয়তার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।”

শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু সেই বিনিয়োগ হোক গ্রিন ফিল্ডে। যেমন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনোমিক জোনগুলোতে বিদেশিরা এসে বিনিয়োগ করছে। ঠিক তেমনি আমাদের বে-টার্মিনাল হতে শুরু করে সীতাকুন্ড-মিরসরাই ও মাতারবাড়িতে প্রচুর বিনিয়োগের সুবিধা রয়েছে। সেখানেই বিনিয়োগ আসুক। কিন্তু আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরিকৃত টার্মিনাল (যেখানে কোনো বিনিয়োগের দরকার নেই) কেন বিদেশিদের দেয়া হবে তা বোধগম্য নয়।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের সকল আপামর জনসাধারণের স্বার্থে এবং দেশের স্বার্থে, চট্টগ্রাম বন্দরের চালুকৃত টার্মিনাল এনসিটি টার্মিনাল (যেটি পূর্বের ফ্যাসিস্ট সরকারের এজেন্ডা) বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। পাশাপাশি এই ষড়যন্ত্রের সাথে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য অনুরোধ করছি। অন্যথায়, ছাত্র-জনতা আবারও দেশ ও বন্দর রক্ষার জন্য যেকোনো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।

“চট্টগ্রাম বন্দরের ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের অলাভজনক দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করে জি টু জি-এর পরিবর্তে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে বন্দরের দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থান অক্ষুণœ রেখে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালনা করতে হবে। এতে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি হবে এবং বন্দর প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করতে পারবে। দেশের টাকা বিদেশে যাওয়া হতে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি পতেঙ্গা টার্মিনালের দেশ বিরোধী চুক্তি দেশের জনগণের কাছে উন্মোচন করতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি দ্বারা চুক্তিটি পর্যালোচনা করতে হবে। অন্যথায়, শ্রমিক-ছাত্র-জনতা আবারও দেশ ও দেশের মানুষের ভবিষ্যতের জন্য যে কোনো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।”Ñ বলেন সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী।

এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরী নায়েবে আমীর ও পরিবেশবিদ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মহানগরী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন, নগর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাওলানা খাইরুল বাশার, এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মোহাম্মদ উল্লাহ, ফয়সাল মুহাম্মদ ইউনুছ ও মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১০ সংসদীয় আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী, চট্টগ্রাম-৯ সংসদীয় আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থী ডা. এ কে এম ফজলুল হক, চট্টগ্রাম-১১ সংসদীয় আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ শফিউল আলম, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব জাহেদুল করিম কচি, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন চট্টগ্রাম মহানগরী সভাপতি এস এম লুৎফর রহমান, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন চট্টগ্রাম মহানগরী সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব, নগর জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য হামেদ হাসান ইলাহী, আমির হোসাইন, বন্দর থানা আমীর মাহমুদুল আলম, চকবাজার থানার নায়েবে আমীর আবদুল হান্নান, কোতোয়ালী থানা সেক্রেটারি মোস্তাক আহমদ, বন্দর ইসলামী শ্রমিক সংঘের সেক্রেটারি মোহাম্মদ ইয়াছিন, শ্রমিক নেতা আদনান প্রমুখ।