“আমি খুনি হাসিনার বিচার চাই। আমরা মায়েরা আর কিছু চাই না। আমাদের বুক খালি করছে। শুধু চাই, হাসিনার বিচার হোক, আর কিছু চাই না। বিচার হলে আমরা একটু শান্তি পাব। সাকিবের স্মৃতি ধরে রাখতে যদি বাড়ির পাশের একটি সড়ক কিংবা কোনোকিছুর নাম দিতো তাহলে আমি স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে পারতাম। আমার ভালো লাগতো। আনন্দও লাগতো।” শহীদ শেখ মো. সাকিব রায়হানের প্রথম শাহাদাৎবার্ষিকীতে এমনটাই জানালেন এই শহীদের মাতা মোসাম্মৎ নুরনাহার। খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন ১৮ নং ওয়ার্ডস্থ গোলাম মোক্তাদির সড়কের নবপল্লি এলাকায় কথা হয় শহীদ সাকিবের গর্বিত পিতা-মাতার সঙ্গে। শহীদ সাকিবের গর্বিত পিতা শেখ আজিজুর রহমান বলেন, “আমার সাকিবকে ছাড়া দেখতে দেখতে ১৯ জুলাই একটি বছর হয়ে গেল! ওর শাহাদাৎবার্ষিকীতে আমার মুদি দোকান খুলিনি।”
ছেলের সঙ্গে শেষবার কথা বলার স্মৃতিচারণ করে নুরনাহার বলেন,“আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। আমার সঙ্গে সাকিবের শেষ কথা হয় বুধবার (১৭ জুলাই)। ওই দিন আমি সারা দিন ফোন দেওয়ার পরও ধরে না। আসরের পর মোবাইল ধরে কেঁদে দেয়। আমি বলি-‘আব্বু, ফোন ধরিস না কেন? আমি মরলে তোরা জানবি না। আমি যাইতে চাই, তোর শরীর ভালো না। ’ ও বলে, ‘জ্বরটা কমেনি, ব্যথাও কমেনি। ’ আমি বলি ‘ওষুধ কিনে দিলাম খাওনি?’ ও বলে, ‘খেয়েছি, তাতে কাজ হয়নি। আবার আনতে হবে।’ আমি বলি ‘আমি ঢাকায় চলে আসছি। আমার মন টিকছে না।’ ও বলে, ‘আজকে এখানে অনেক গোলাগুলি।’ আমি বলি ‘তুমি কিন্তু যাবা না।’ সে বলে, ‘না আম্মু মাথা খারাপ!’ আমি বললাম‘ ৫ আগস্ট আসতেছি। ’ ও বলে, ‘৫ তারিখে তুমি এসো একসাথে বাসা খুঁজব। আমার এখন শরীরটা ভালো না।’ সাকিবের সাথে ওই আমার শেষ কথা।“ সাকিবের মা বলেন, “বৃহস্পতিবার যুদ্ধে যাওয়ার আগে ওর বন্ধুরা ওকে বলে, ‘তুই যে যাচ্ছিস! তোর বাপ-মায়ের কী হবে?’ ও তাদের বলে, ‘তোরা থাম, আমার আব্বু-আম্মুর আরেকটা ছেলে আছে, সে দেখবে। আমি বিয়ে করব, এরপর আমার ছেলেপেলে যদি বলে, ২০২৪ সালে তুমি কী করেছ? আমি যদি আহত হই, তবুও বলতে পারব অংশগ্রহণ করেছি। ’ ওই দিন বুকে গুলি লাগার পর সাকিব, ওর বন্ধুদের বলে, ‘ভাই. আন্দোলন চালিয়ে যেয়ো, বন্ধ করো না’। ”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলে হারানো এই বাবা বলেন, মিরপুর-১০ নম্বরে ফ্যাসিস্ট সরকারের পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনে অংশ নেয় সাকিব। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সে শহীদ হয়। আমি দোকানের একটি তালা খুলেছি। আসরের শেষ ওয়াক্তে আমার কাছে একটা কল আসে, বলে-আঙ্কেল সাকিব রায়হান আপনার কী হয়? আমি বললাম, আমার ছোট ছেলে। আমাকে বলে-একটা এ্যাম্বুলেন্স পাঠান। আমি এ্যাম্বুলেন্স কী করে পাঠাব? সে জানতে চায়, আপনি কোথায়? আমি বলি, আমি তো খুলনায়, আমার ছেলে ঢাকায়। আমি কী করে এ্যাম্বুলেন্স পাঠাব? তখন সে বলে, আপনার ছেলের বুকে গুলি লেগেছে!”
“এই কথাটা বলার পরই ফোনটা কেটে দেয়। আমি তখন চিৎকার করে উঠি। সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে। আমি তখন চিন্তা করি, ওর মা অসুস্থ। সে জানলে তো স্ট্রোক করবে। আমি সবাইকে বললাম, এই কথা কাউকে বলো না। এরপর বাসায় এসে সাকিবের মাকে বললাম চলো ঢাকা যাব। সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে এসে টিকিট কাটলাম। ” সাকিবের পিতা বলেন, “আমার বড় ছেলেকে ফোন দিলাম। সে-ও আন্দোলনে ছিল। কিন্তু ছোট ভাই জানতো না বড় ভাই আন্দোলনে গেছে, আর বড় ভাই জানতো না ছোট ভাই আন্দোলনে। বড় ছেলে গুলির মধ্যদিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ফোন ধরে বলে, আব্বু কী হয়েছে? আমি বলি, তুই আমার ছোট ছেলেকে বাঁচা! ও জানতে চায় কী হয়েছে? আমি বলি, বুকে গুলী লেগেছে। কোন জায়গায়? মিরপুর ১০ নম্বরে। এই পর্যন্ত আমাদের কথা শেষ। ”
“আমি সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে টিকিট কাটলাম। বড় ছেলে হাসপাতালে গিয়ে আমাকে বলে, ‘তুমি কান্নাকাটি করো না, তোমার ছেলের কিছু হবে না। ’ এ পর্যন্ত ওর মা কিছু জানে না। এর কিছুক্ষণ পর বড় ছেলে ফোন করে বলে, ‘আব্বু তুমি এসো না, তোমার আসা লাগবে না। তোমার ছেলেকে নিয়ে আমি আসতেছি। আমার ভাই আর নেই। ’ আমি বাসের হেলপারকে বললাম, আমরা যাব না, আমার ছেলে আর নেই! ওরা আমার টাকাটা দিয়ে দেয়। বড় ছেলে আবার ফোন করে বলে, ‘আব্বু কারফিউ দিয়ে দিয়েছে’। মেয়ে-জামাইকে ফোন দিলাম। বোন-জামাই, মেয়ে-জামাই ওরা এ্যাম্বুলেন্সে করে আনলো। ১৯ তারিখ মারা গেলো। ২০ জুলাই খুলনা মহানগরীর বসুপাড়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।”