খুলনায় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলুর (৬০) রহস্যজনক মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে নৌ-পুলিশের পাশাপাশি একাধিক গেয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত র্যাব, পিবিআই ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। নৌ-পুলিশ বলছে-বুধবারের মধ্যে এটি হত্যা না আত্মহত্যা পরিস্কার হয়ে যাবে। সোমবার সাংবাদিক বুলুর ভাই আনিসুজ্জামান দুলু বাদী হয়ে লবণচরা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা (নং ২০) দায়ের করার পর জোরেসোরে তদন্ত শুরু করেছে নৌ-পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নৌ পুলিশ পরিদর্শক আবুল খায়ের শেখ বলেন, বিভিন্ন কারণ সামনে রেখে তদন্ত শুরু হয়েছে। এরমধ্যে পারিবারিক সমস্যা, অর্থ লেনদেন বিষয়গুলো সামনে রেখে আমরা এগোচ্ছি। তিনি জানান, সোমবার সন্ধ্যায় বুলুর বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া দ্বিতীয় স্ত্রী তানিয়া সুলতানা ফোন করেছিল। মঙ্গলবার তার আসার কথা থাকলেও তিনি ফোন ধরছেন না। তিনি জানান, বুলু সেতুর ৬০-৭০ ফুট উচু থেকে পড়ে যাওয়ায় তার মুখ থেতলে গেছে। এছাড়া তার কোমর ও পা ভেঙ্গে গেছে। আমরা প্রতিটি বিষয় চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এগোচ্ছি।
খুলনা নৌ পুলিশের এসপি ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। সাংবাদিক বুলুকে রূপসা সেতু থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে কি না বা তিনি নিজে লাফ দিয়েছেন কি না এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া উদ্ধারকৃত বুলুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন লক ছিল। সেটি খোলা হয়েছে। এখন কল লিস্ট পরীক্ষা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আশাকরি বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে একটা রেজাল্ট আপনাদের দিতে পারবো।
এদিকে মঙ্গলবার নৌ পুলিশের এসপি অফিসে আসেন সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলুর ভাই ও মামলার বাদী আনিসুজ্জামান দুলু, বুলুর মামা নাজমুল ইউসুফসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদের সাথে কয়েক ঘন্টা কথা বলেন এসপি ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ। সেখান থেকে বেরিয়ে তারা আবারও বলেন, সাংবাদিক বুলুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। আমরা জানতে পেরেছি যে- কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী তানিয়া সুলতানা জোর করে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে ৭ লাখ টাকা নিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করেছেন। ওই সময় তানিয়া নাকি তিন মাসের অন্তঃসত্বা ছিলেন। তাহলে আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- অন্তঃসত্তা থাকা অবস্থায় কিভাবে বিচ্ছেদ হয়। এটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে।
এছাড়া আমরা জানতে পেরেছি যে-বুলু ২৫ লাখ টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে রেখেছিল। ওই টাকা উঠিয়ে বেসরকারী সামি নামের একটি হাসপাতালে (ক্লিনিক) বিনিয়োগ করে। নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন মোল্লা বাড়ি মোড়ে অবস্থিত ওই ক্লিনিকের মালিক ছিলেন সেলিম নামের এক ব্যবসায়ী। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে সেলিম আত্মগোপনে চলে যান এবং কিছুদিন পর ওই ক্লিনিকটি দেড় কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। কিন্তু বুলুর পাওনা ২৫ লাখ টাকা আর ফেরত দেননি।
এদিকে সাংবাদিক বুলুর লাশ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে এক নারীর সঙ্গে রূপসা সেতুতে দেখা গেছে। দু’জনের মধ্যে ঝগড়ার একপর্যায়ে বুলুকে সেতু থেকে নিচে লাফ দিতে দেখা যায়। ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে এসব তথ্য দিয়েছে কোস্টগার্ডোর একটি সূত্র।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ওয়াহেদ-উজ-জামান তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন। মেজ ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক বছর আগে মারা যান। ছোট ভাই আনিছুজ্জামান দুলু ঢাকায় ব্যবসা করেন। নগরীর শিববাড়ি মোড় সংলগ্ন ইব্রাহিম মিয়া রোডে তাদের পৈতৃক বাড়ি থাকলেও সেটি চার বছর আগে বিক্রি করা হয়। এরপর ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলু সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার দ্বিতীয় ফেজে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। প্রায় চার মাস আগে তার স্ত্রী নিখোঁজ হন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাগমারা এলাকায় নতুন বাসায় ওঠার কথা ছিল তার।
পরিবার আরো জানায়, পারিবারিক কলহের কারণে তার প্রথম স্ত্রী এলিজা পারভীন গত ১১ মে সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। অদ্যাবধি তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। অর্থ সংকট, পারিবারিক অশান্তির কারণে বুলু খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন। সূত্র জানায়, সব হারিয়ে মানুষিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে বেশ কিছুদিন আগেও একবার খুলনা রেল স্টেশনে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বুলু। তখন স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।
রূপসা সেতুতে থাকা ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে কোস্ট গার্ডের সূত্র জানায়, রোববার দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে রূপসা সেতুর ওপর ঘোরাঘুরি করছিলেন সাংবাদিক বুলু। এ সময় তার সঙ্গে এক নারী ছিলেন। তাদের দুজনকে ঝগড়া করতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে বুলু সেতু থেকে নিচে লাফ দেন। ওই নারী তখন চিৎকার-চেঁচামেচি করে লোক ডাকেন। ওই নারীকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, খুলনার সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলু। তিনি দৈনিক বঙ্গবাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজ, চ্যানেল ওয়ান, ইউএনবি ও দৈনিক প্রবাহ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান ছিলেন। তিনি খুলনা প্রেসক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন (কেইউজে) ও বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন।