রাজশাহীর আবাসন ব্যবসায়ে ধস নেমেছে। ফ্ল্যাট বেচা-বিক্রি কমে যাওয়ায় আবাসন কোম্পানিগুলো পড়েছে বিপাকে। এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কোন উপায় নেই বলে মনে করেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠনের একজন নেতা জানান, কালো টাকা ও বিপুল বিত্তের মালিক বনে যাওয়া লোকদের একটি বড় অংশ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গা-ঢাকা দেয়ায় মূলত এই খাতের বিনিয়োগ ও আর্থিক লেনদেন হ্রাস পেয়েছে। ফলে গত এক বছর ধরে রাজশাহীতে ফ্ল্যাট বিক্রি নেই বললেই চলে। এমন পরিস্তিতিতে চরম সংকট মোকাবিলা করছে রাজশাহীর আবাসন শিল্প। এরই মধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে ২৫ থেকে ৩০টি আবাসন কোম্পানি। এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাকি কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ফ্লাটের চাহিদা কমে যাওয়ায় দামও পড়ে গেছে। ফলে ব্যববসায়ীরা পার করছেন চরম দুর্দিন।
রাজশাহীতে আবাসন শিল্পের শুরু ২০১০ সালের দিকে হলেও ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের দিকে ব্যবসা জমে উঠে ব্যাপকভাবে। দ্রুত গতি পায় আবাসন ব্যবসা। ২০২০ সালে করোনায় একবার হোচট খেলেও তা সামলে উঠেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর এবার আবাসন শিল্পের ধস আশংকাজনক অবস্থায় পড়েছে। রাজশাহী মহানগরীর উত্তরে উপশহর ও ভদ্রা আবাসিক, পূর্বে কাজলা, বিনোদপুর, মির্জাপুর, মধ্য শহর কুমারপাড়া, সাহেব বাজার, সাগরপাড়া, পশ্চিমে কাজিহাটা, সিপাইপাড়া, লক্ষ্মীপুর, তেরখাদিয়া সিটি বাইপাস সড়ক, বহরমপুর, শালবাগানসহ শহরজুড়েই আবাসন ব্যবসা ছিল রমরমা। লক্ষ্মীপুর, উপশহর, ভদ্রা আবাসিক ও সাহেব বাজার এলাকায় ফ্ল্যাটের চাহিদা ছিল পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। এখন নগরীর সবগুলো এলাকায় স্থবির ফ্ল্যাট কেনাবেচা।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকটাই দিশেহারা রাজশাহীর আবাসন ব্যবসায়ীরা। একজন ব্যবসায়ী বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট এর পরে ফ্ল্যাট বিক্রয় নেই বললেই চলে। প্রতিটি কোম্পানির ক্ষেত্রে একই চিত্র। সরকারী কর্মকর্তা ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে একধরণের ভয়ের মধ্যে আছেন। রাজনৈতিক সরকার গঠন হলে ক্রেতারা হয়তো নতুন করে ভাববে। একবছর আগের তুলনায় ফ্ল্যাটের দাম অনেকটাই কমেছে। ফ্লাটের চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম পড়ে গেছে। অনেক কোম্পানির কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ ও বিভিন্ন খাত থেকে বিনিয়োগ নিয়ে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন। ব্যবসা সচল না থাকায় ভাবিয়ে তুলেছে তাদের। ফ্লাট বিক্রি না হলে ঋণ পরিশোধ, অফিসের স্টাফদের বেতন, অফিস ভাড়া, বিদ্যুত বিল পরিশোধ করতে হয় নিয়মিতই। তবে ফ্ল্যাট বিক্রি না হওয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন গলার কাঁটা হয়ে গেছে অনেকটাই। মাঝপথে প্রজেক্ট ছেড়ে উঠে আসারও উপায় নাই বলে উভয় সংকট তৈরি হয়েছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘রেডা’র সভাপতি তৌফিকুর রহমান বলেন, দেশে গণঅভ্যুত্থানের পর আবাসনখাতে ধ্বস নেমেছে। একবারেরই স্থবির হয়ে গেছে এ খাত। বিভিন্ন ধরনের অর্থের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ ফ্ল্যাট কিনছে না। ব্যাংকিং সেক্টরের গৃহঋণ প্রায় বন্ধ। এমনকি ব্যাংকের কর্মীরাও বিনিয়োগ পাচ্ছেন না সহজে। তিনি বলেন, “আমার ৪টি প্রজেক্ট চলছে। কিন্তু কোনো ফ্ল্যাট বিক্রি না হওয়ায় বেকায়দা অবস্থা, প্রতিষ্ঠান ধরে রাখাই মুশকিল। আবাসন খাতের এ ব্যবসায়ী আরো বলেন, সরকার আবাসন কোম্পানিগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা না দিলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে। কম মুনাফায় ঋণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে কোম্পানিগুলো।”
এদিকে রড, সিমেন্ট, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম স্থিতিশীল থাকলেও সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বালির দাম। একবছর আগে লোকাল বালি ট্রাক প্রতি পৌঁছে দেয়ার দাম ছিল স্থান ভেদে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা, তা বেড়ে হয়ে গেছে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। বালির দাম বৃদ্ধি যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ২০২০ সালে করোনায় ব্যবসা একবার হোচট খায়। ২২ ও ২৩ সালের দিকে দ্রব্যমূল্যসহ ভবন নির্মাণের সামগ্রীর দাম ৩ থেকে ৫ গুণ বেড়ে যায়। ফলে ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়ে। যৌথমালিকানাসহ রাজশাহীতে ১৩৫টির মতো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ছিল। ব্যবসা চালাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠান। এখন ৪০ থেকে ৫০টি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে কোনোমতে। তিনি আরো বলেন, “বর্তমান সময়ে নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেকটা কমেছে, তবে বালির দাম অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তবে আমি ভবিষ্যতের ব্যবসা নিয়ে আশাবাদী, রাজনৈতিক স্থিতিশীল হলে ব্যবসা আবার চাঙা হবে বলে আশা করি।”