দীর্ঘ খরায় মৌলভীবাজার জেলার চা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা মৌসুমের শুরুতেই বৈরী আবহাওয়া। তাই এ বছর আশানুরুপ উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় চা শিল্পের লোকজন। দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে চা গাছে আসছে না নতুন কুঁড়ি। আর যে গাছগুলোতে কুঁড়ি আসছে তাও প্রচন্ড রোদ ও চৈত্রের তাপদাহে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খরার প্রভাবে বাগানগুলোতে চায়ের উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। পানির অভাবে গাছগুলো বিবর্ণ হয়ে পাতা পুড়ে যাচ্ছে। খরার কারণে মশা ও লাল মাকড়ের আক্রমণসহ নানা প্রজাতির পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের উপদ্রব বেড়েছে। এ অবস্থায় চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বাগান মালিকরা। চা-বাগানের পেছনে নিয়মিত বিনিয়োগ ও পরিচর্যা করে লাভের মুখ দেখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, জেলায় ৯২টি চা-বাগান রয়েছে। খরায় নতুন সৃজিত চায়ের প্রায় ৪৫ শতাংশ চারাগাছ ও ১৫ শতাংশ পুরাতন চায়ের গাছ পুড়ে গেছে। চা-বাগান কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু টিলায় নিয়মিত সেচ দিয়ে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষায় প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। চা শ্রমিকরা জানান, অনাবৃষ্টির কারণে চা-বাগানের নতুন গজানো গাছের পাতা রোদে পুড়ে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে রোগবালাই। এখন চা-পাতা তোলার মৌসুম। কিন্তু যে হারে পাতা চয়ন করার কথা, সেভাবে পাতা নেই। চা বাগান মালিকরা জানান, বৃষ্টি না হওয়ায় এখন কোনো উৎপাদন নেই বললেই চলে। দু-একটি বাগানে পাতা চয়ন শুরু হলেও তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। কেজিতে ২০-৪০ টাকা ঘাটতি দিয়ে চা-শিল্প কতদিন টিকে থাকবে এমন প্রশ্ন সবার। বৃষ্টি ও সহনীয় তাপমাত্রা চা উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি। বৃষ্টি না হওয়ায় কৃত্রিমভাবে পানির ব্যবস্থা করে চা-গাছে ছিটানো হচ্ছে। কিন্তু সব জায়গায় ইরিগেশন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, চায়ের জন্য ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আদর্শ। তবে সর্বোচ্চ ২৯ ডিগ্রি পর্যন্ত চা গাছ সহ্য করতে পারে। এর উপরে গেলেই খরায় পুড়ে যায়। পানির সংকট দেখা দিতেই নতুন কুঁড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাগানে যথেষ্ট পরিমাণ ছায়া প্রদানকারী গাছ থাকলে ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহনীয় থাকে। জেলায় এখন তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি থেকে ৩৬ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এবার মৌসুমের প্রথম দিক থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে না। এই বৃষ্টি চা-গাছের জন্য খুবই উপকারী ছিল। বৃষ্টি না হলে বাগানের ক্ষতির শঙ্কা বেশি। শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান জানান, এই সময়ে চা অঞ্চলে ১৫-২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গেল বছরের মার্চ মাসে ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। অথচ চলতি বছরের মার্চে মাত্র ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাগান মালিকরা জানান, এমন অবস্থা চলতে থাকলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা যাবে কিনা তা নিয়ে তারা সন্দিহান। তবে সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যা আর প্রতিকূল আবহাওয়া কাটিয়ে উঠলে উৎপাদনের পরিসংখ্যান ধরে রাখা সম্ভব বলে আশাবাদী চা গবেষকরা। এজন্য চা উৎপাদনের বিরূপ আবহাওয়ায় চা গাছগুলোর সঠিক পরিচর্যা ও আরও অধিক যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ তাদের। তথ্যমতে, দেশে ১৬৬টি চা-বাগানের মধ্যে ১৪৫টি চা-বাগানের অবস্থান সিলেটে। এর মধ্যে ৯২টি চা-বাগানের অবস্থান মৌলভীবাজারে। এখনকার পাহাড়ি টিলা, মাটি, ভৌগোলিক অবস্থান আর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অগ্রসর হচ্ছে এ শিল্প। ধরে রাখছে তার ঐতিহ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনাবৃষ্টি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শ্রমিক অসন্তোষ বিকাশমান এ শিল্পের অগ্রযাত্রা অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে।
সেজন্য এ অঞ্চলে চা শিল্পের অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে নানাভাবে প্রাকৃতিক নির্ভরশীলতা কমানোর তাগিদ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের।
গেল কয়েক বছর থেকে দেশে চায়ের উৎপাদন অতীতের রেকর্ড ভেঙে অগ্রসর হচ্ছে। এটা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আশান্বিত করছে। চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা- এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠলে এ বছরও চায়ের উৎপাদন ভালো হবে।