জুবায়ের হোসেন, নাটোর : একসময় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকা বাইচ। সভ্যতার বিবর্তনে বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ এ উৎসবটি। ঐতিহ্য ধরে রাখতে নাটোর জেলা প্রশাসন চলনবিলের গুরুদাসপুরের বিলসা পয়েন্টে প্রায় ৪০ বছর পর আত্রাই নদে নির্মিত ‘মা জননী’ সেতুর নিচে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। গতকাল বিকেলে গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা গ্রামে শুরু হয় নৌকাবাইচের সেই বহুল প্রতীক্ষিত মহোৎসব। ‘নদী দূষণ রোধ করি, নির্মল বাংলাদেশ গড়ি’ প্রতিপাদ্যে নৌকা বাইচ উৎসবকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড় মুখরিত হয়ে ওঠে। নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে বিলের মাঝখানে দুই দিকে হাজার হাজার নৌকার থাকা দর্শনার্থীরা উপভোগ করেছেন ওই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। বাইচের নৌকাগুলো বাদ্যের তালে তালে বৈঠা মেরে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। নৌকার গতি আর মাঝি-মাল্লাদের ছন্দোবদ্ধ বৈঠা চালানোর দৃশ্য দর্শকদের মুগ্ধ করে। বৈঠার তালে তালে জেগে ওঠে ছন্দ-আনন্দ আর দর্শকদের উল্লাস ও করতালি আনন্দের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলে। এই গ্রামীণ উৎসব দেখতে নাটোর, সিরাজগঞ্জ,বগুড়া ও পাবনা জেলার লাখখানেক দর্শকের সমাগম হয়েছিল। তুমুল বৃষ্টি এই নির্মল বিনোদন থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। সকাল থেকে মানুষ দুই পাড়ে জড়ো হতে শুরু করেন। সন্ধ্যা অবধি অনুষ্ঠিত হয় এই ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। এত দর্শকের উপস্থিতিই প্রমাণ করে চলনবিলের মানুষের কাছে এখনো এটিই সেরা প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ১২টি নৌকা। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থেকে নৌকা বাইচ দেখতে এসেছিলেন স্কুল শিক্ষক আব্দুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, একটি প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নানা বয়সি মানুষ এভাবে ভিড় করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না। নৌকাবাইচ নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস খুব ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন বিলসা গ্রামের বাসিন্দা স্বাস্থ্যসচিব সাইদুর রহমান। তাঁর আগ্রহেই জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের বিলসা গ্রামে নৌকাবাইচ আয়োজিত হয়। তাঁর সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে এসেছিলেন রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার আজিম উদ্দিন, রাজশাহীর রেঞ্জ ডিআইজি শাহজাহান আলী, নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন, পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম প্রমুখ। নৌকাবাইচে চূড়ান্ত ধাপের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ‘নিউ একতা এক্সপ্রেস’ সেরার খেতাব অর্জন করে। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ‘বাংলার বাঘ’ নামের একটি নৌকা। আর তৃতীয় স্থানে ছিল ‘আল মদিনা’ নামের নৌকা। সেরা নৌকাকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় একটি মোটরসাইকেল, দ্বিতীয় পুরস্কার রেফ্রিজারেটর ও তৃতীয় পুরস্কার ছিল এলইডি টেলিভিশন। নিউ একতা এক্সপ্রেসের দলনেতা লিটন আলী। তাঁর কাছে মোটরসাইকেলের চেয়েও বেশি আনন্দের বিষয় ছিল, চ্যাম্পিয়ন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের একসঙ্গে দেওয়া করতালি। করতালির উচ্ছ্বাসে তাঁর সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে বলে জানান। নৌকাবাইচের সমন্বয়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবুল হায়াতের জন্মও চলনবিল এলাকাতেই। তার ভাষ্য, বিল পাড়ের মানুষদের বিনোদন দিতে নৌকাবাইচকেই বেছে নিয়েছেন।