যশোরের ব্যস্ততম সড়ক প্যারিস রোড। শহরের কোলাহলে হঠাৎ চোখে পড়লো এক বৃদ্ধ। বয়স ৮০। নাম সুরত আলী। পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি আর পুরনো শার্ট। ঝুড়িতে কয়েক মুঠ শাকপাতা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রির অপেক্ষায়। কাছে গিয়ে কথা বলতেই জানা গেলো এক জীবনব্যাপী সংগ্রামের গল্প।
সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলায় জন্ম সুরত আলীর। চার ছেলে, দুই মেয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু তাদের মানুষ করতেই কেটেছে। কখনো রিকশা চালিয়ে, কখনো ক্ষেতের কাজ করে, আবার কখনো দিনমজুরি খেটে। আজ সবাই বিবাহিত। কেউ যশোরে, কেউবা অন্য জায়গায়। তবে দূরত্ব শুধু ভৌগোলিক নয়, মনেও।
বৃদ্ধ সুরত আলী জানালেন, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তার ছেলেরা কেউ বাবার খোঁজ নেয় না। ঈদের দিনটিতেও বাবার জন্য একবার ফোন করেনি। অথচ এই সুরত আলীর কাঁধেই এক সময় ছেলেরা বেড়ে উঠেছিল। আজ সেই বাবার ঠিকানা শহরের এক ভাড়া ঘরে। যশোরের খড়কি এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে কোনোমতে কাটছে তার জীবন।
প্রতিদিন ভোরে শহরতলির বিল-জলাশয় থেকে খুটে খুটে শাকপাতা সংগ্রহ করেন। তারপর শহরের রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বিক্রি করেন ২০০ টাকার মতো। সেই টাকাতেই সংসার চলে। তিন বেলা খাবার, অসুস্থ স্ত্রীর ওষুধ আর এক হাজার টাকা ঘর ভাড়া সবকিছুর যোগান দিতে হয় এই টাকায়। কখনো কখনো বিক্রি কম হলে সেদিন অভুক্তই থাকতে হয় দুজনকে।
কথায় কথায় জানালেন, এখন আর চোখেও ভালো দেখতে পান না। বয়সের ভারে শরীর দুর্বল। আগে রিকশা চালাতেন, এখন তা-ও পারেন না। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুরত আলীর বড় আফসোস, এই দেশে গরিবের খবর কেউ রাখে না। যদি কখনো ইসলামি দল সরকারে আসতো, তাহলে সুরত আলীদের জন্য কিছু করতো। এখন তো আমরা শুধু বেঁচে থাকার যুদ্ধ চালাই।
বৃদ্ধের কথায় ভারী এক বেদনা। স্ত্রী অসুস্থ। তিনিও সারাদিন শাক বিক্রি শেষে রাতে স্ত্রীর সেবায় থাকেন। নিজের হাতে রান্না করেন। মুখে তুলে দেন স্ত্রীর আহার। মাঝের মধ্যে বড় মেয়ে আসেন খোঁজ নিতে। বাকি ছেলেমেয়েরা খবর রাখে না। অথচ এ-ই মানুষটা নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছিলেন।
এক সময়ের রিকশাচালক সুরত আলীর জীবন এখন শুধুই বেঁচে থাকার সংগ্রাম। তার জীবনে না আছে অবসর, না আছে ছায়া। কেবল স্মৃতি আর কষ্টের ভার নিয়ে তিনি হাঁটছেন যশোর শহরের রাস্তায়।
কত যে সুরত আলী আমাদের আশপাশেই বেঁচে আছেন, আমরা জানিই না। সমাজে যখন সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, তখন এমন বৃদ্ধের গল্প আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। প্রয়োজন সমাজের প্রতি, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ। কারণ, আজ যারা বৃদ্ধ, তারাই একদিন আমাদের পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।