শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা : বাংলাদেশে চায়ের সুবাস ছড়িয়ে আছে প্রায় ১৭১ বছর ধরে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ শিল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। এরপর ধীরে ধীরে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ বৃহত্তর সিলেট জুড়ে গড়ে ওঠে একের পর এক চা বাগান। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়, আর এই ঐতিহ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত শ্রীমঙ্গল।

চায়ের রাজধানীখ্যাত এই শ্রীমঙ্গলেই গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র চা জাদুঘর। বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত চা শিল্পের নানা দুর্লভ নিদর্শন স্থান পেয়েছে এখানে। ফলে এটি শুধু একটি প্রদর্শনী কেন্দ্র নয়, বরং বাংলাদেশের চা শিল্পের ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল।

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের পাশে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ চা বোর্ড পরিচালিত 'টি রিসোর্ট'-এর অভ্যন্তরে এই জাদুঘরটি অবস্থিত। চারপাশে সবুজ চা বাগান, পাখির ডাক আর প্রকৃতির নির্জনতা দর্শনার্থীদের নিয়ে যায় এক ভিন্ন পরিবেশে। এর ভেতরে প্রবেশ করলেই যেন খুলে যায় ইতিহাসের একেকটি দরজা।

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চা শিল্পের প্রায় ১৭১ বছরের বিচ্ছিন্ন ইতিহাস ও নিদর্শনগুলো বিভিন্ন চা বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। নতুন প্রজন্মকে এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই বাংলাদেশ চা বোর্ড শ্রীমঙ্গলে একটি চা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এবং ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এ জাদুঘর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

জাদুঘরে রাখা হয়েছে প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি দুর্লভ আসবাব ও সামগ্রী। এগুলো একেকটি যেন চা শিল্পের ইতিহাসের পাতা। বৃটিশ আমলের টারবাইন পাম্প, কাঠ-পাথরে রূপান্তরিত বিরল গাছের ফসিল, হস্তচালিত নলকূপ, সার্ভে চেইন, লিফট পাম্প, কেরোসিনচালিত ফ্রিজ, প্রাচীন লোহার লাঙ্গল, সিরামিক জার, বৈদ্যুতিক পাখা, টাইপরাইটার, পিএইচ মিটার, বেতার যন্ত্র, এমনকি ভগ্ন উড়োজাহাজের খন্ডাংশও এখানে স্থান পেয়েছে।

এছাড়া রয়েছে পুরনো মুদ্রা, রূপার গহনা, তামার ঘটি, লেদ মেশিন, কাটা কোদাল, প্রুনিং দা, কেরোসিনচালিত ফ্রিজ, ড্রেসিং টেবিল, লোহার বাথটাবসহ অসংখ্য মূল্যবান নিদর্শন। প্রতিটি জিনিসই যেন অতীত দিনের একেকটি গল্প বলে দেয়। এই জাদুঘরের প্রতিটি নিদর্শন এসেছে দেশের নামকরা চা বাগানগুলো থেকেও। যেমন দেওরাছড়া চা বাগান থেকে হস্তচালিত নলকূপ ও বৈদ্যুতিক পাখা, লাল্লাখাল চা বাগান থেকে কাঠে রূপান্তরিত বিরল গাছের ফসিল, কোদালা চা বাগান থেকে প্রাচীন ঘড়ি, প্লান্টিং হো, লোহার বাথটাব, কেরোসিন ফ্রিজ, কর্ণফুলি চা বাগান থেকে টাইপরাইটার, কষ্টিপাথরের প্লেট, পুরনো মুদ্রা, রেডিও, বারমাসিয়া চা বাগান থেকে লেদ মেশিন ও তীর-ধনুক, লালচান্দ চা বাগান থেকে সিরামিক ঝাড় ও ড্রায়ারের অংশ, রাজনগর চা বাগান থেকে প্রাচীন মদ্রা ও রিং কোদাল, কুলাউড়া থেকে বিধ্বস্ত বিমানের খন্ডাংশ, লস্করপুর চা বাগান থেকে মাদুলিছড়া প্রভৃতি। প্রতিটি নিদর্শনই শুধু একটি সামগ্রী নয়, বরং চা শিল্পের সোনালি অতীতের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য।

শ্রীমঙ্গলের চা জাদুঘর শুধু চা শিল্পের অতীতকে ধারণ করছে না; এটি এখন পর্যটনের নতুন এক আকর্ষণেও পরিণত হয়েছে। দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীরা এখানে এসে বাংলাদেশের চা শিল্পের ইতিহাস এবং সাফল্যের গল্প সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন। গবেষকদের জন্যও এটি এক অনন্য ভান্ডার। কারণ এত নিদর্শন এক জায়গায় সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদাহরণ দেশে আর নেই। শ্রীমঙ্গলের এই চা জাদুঘর নিছক একটি প্রদর্শনী কক্ষ নয়, বরং বাংলাদেশের চা শিল্পের ঐতিহ্যের দর্পণ। এখানে প্রবেশ করলে দর্শনার্থীরা যেন পাড়ি জমায় বৃটিশ আমলের সেই দিনগুলোতে, যখন চায়ের সুবাস প্রথম ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার মাটিতে। চা শিল্পের গৌরবগাথা জানতে চাইলে বা ঐতিহ্যের স্বাদ নিতে চাইলে এই জাদুঘর হতে পারে সবার জন্য এক অনন্য গন্তব্য। দেশের গর্বের চা শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই জাদুঘর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা।