আয়ুর সীমাবদ্ধতার কারণেই ‘অমরত্বের’ একটা আকাক্সক্ষা মানুষের মধ্যে ছিল। তবে এ স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। জন্মের শর্তই হলো মৃত্যু। তবুও মানুষ বলে, ‘মরিতে চাহিনা এই সুন্দর ভুবনে।’ অমরত্বের আকাক্সক্ষা আবার উচ্চারিত হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন কাঠামোয়। চীনের বেইজিংয়ে ৩ সেপ্টেম্বর বুধবার সামরিক কুচকাওয়াজের এক ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কীভাবে জীবন দীর্ঘায়িত করা যায়, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শোনা গেছে। মাইকে তাদের এ কথোপকথন ধরা পড়েছে। দু’জনের কথোপকথনের অনুবাদ করে জানা গেল-পুতিন বলেছিলেন, জৈবপ্রযুক্তির নানা উদ্ভাবনের ফলে অমরত্ব লাভ করাও সম্ভব। শি, পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন যখন বেইজিংয়ের ঐতিহাসিক তিয়েন আনমেন স্কয়ার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন অসতর্কতাবশত চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে মুহূর্তটি ধরা পাড়ে। কথোপকথনটি অনুবাদ করছিলেন শি-এর রুশ দোভাষী এবং পুতিনের মান্দারিন দোভাষী। পরে বিবিসি সেটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে। শি’র রুশ দোভাষীকে রুশ ভাষায় বলতে শোনা যায়, আগে ৭০ বছরের বেশি বাঁচার ঘটনা ছিল বিরল। আর এখন বলা হয়, ৭০ বছর বয়সের মানুষও শিশু। এরপর পুতিন কিছু একটা বলেন, যা স্পষ্টভাবে শোনা যায়নি। পরে তার দোভাষী মান্দারিন ভাষায় সে কথার অনুবাদ করে বলেন, জৈবপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষের অঙ্গ বারবার প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। এতে মানুষ আরও তরুণ থাকতে পারবে, এমনকি অমরত্বও লাভ করা সম্ভব। এরপর শি জিন পিং-এর দোভাষী বলেন, পূর্বাভাষ অনুযায়ী, এ শতাব্দীতে মানুষের দেড়শ বছর পর্যন্ত বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৩ সেপ্টেম্বর বুধবার বেইজিংয়ে আয়োজিত ওই সামরিক কুচকাওয়াজে চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার নেতাদের প্রথম প্রকাশ্যে একসঙ্গে দেখা যায়। বিশ্লেষকদের মতে, এটি পশ্চিমা বিশ^কে একপ্রকার বার্তা দেওয়ার কৌশল, যারা দীর্ঘদিন ধরে তাদের এড়িয়ে চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আরোপের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করেছে চীন। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার নেতাদের সঙ্গে মিলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) অভিযোগ তুলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ভøাদিমির পুতিন ও কিম জং উনকে আথার উষ্ণ শুভেচ্ছা পৌঁছে দেবেন, যখন আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।’ যে দৃশ্যটা আমরা এতক্ষণ দেখলাম, তার একটা তাৎপর্য আছে। চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে এক মঞ্চে অবস্থান করে যুক্তরাষ্ট্রকে জানান দিলো যে আমরা এখন তোমার পাল্টা শক্তি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন। তাইতো তিনি তাদের উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। রাজনৈতিক মঞ্চের এ যখন চিত্র, তখন আবার অমরত্বের ভাবনায় মগ্ন হলেন কেন শি এবং পুতিন? আমরা জানি শি অনেক দিন ধরেই শাসন করছেন চীন। পুতিন ও দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার অধীশ^র।

ব্যবস্থাপনাটা এমন যে, এ দু’নেতা হয়তো আজীবন ক্ষমতার মসনদে থেকে যাবেন। তবে এখানে বাধা শুধু মৃত্যু। এ কারণেই কি দু’নেতা ‘অমরত্ব’ নিয়ে এতটা আলাপ করলেন। অমরত্ব নিয়ে অতীতেও অনেক আলাপ হয়েছে, গবেষণা হয়েছে। কিন্তু রাজা-বাদশাহদের সেই খোয়াব পূর্ণ হয় নি। সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে। এ সীমাবদ্ধতা মানুষকে মেনে নিতে হয়েছে। গবেষণা শাস্ত্রের নাম বিবিধ হতে পারে, যেমন শি এবং পুতিনের শাস্ত্রের নাম ‘জৈব প্রযুক্তি।’ তবে এ জৈবপ্রযুক্তির উৎকর্ষতা নানাকিছু করতে সমর্থ হলেও মৃত্যুকে জয় করতে সমর্থ হবে না। ‘অমরত্ব’ মানবের সৃষ্টিতত্ত্বের বাইরের বিষয়। সৃষ্টি কী করে ¯্রষ্টার গুণাবলী ধারণ করবে? মহান ¯্রষ্টাই কেবল অমর ও অক্ষয় হতে পারেন। মার্ক্স, লেনিন, মাওসেতুং তো খুবই বড় নেতা ছিলেন। তারা এখন কোথায়? সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে। তাই ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, শি এবং পুতিন অমরত্বের ভাবনা থেকে সরে আসলে ভালো করবেন। তবে তাদেরকে আমি একেবারে হতাশ করতে চাই না। অমর হওয়ার একটা ভিন্ন তরিকা আমি তাদের বাতলে দিতে পারি। আর সেটা হলো, কর্মের মাধ্যমে মানুষ অমর হতে পারে, অমরত্ব লাভ করতে পারে। জৈবিকভাবে মানুষ মরে গেলেও মহৎ কাজ মানুষকে অমর করে রাখে। শুধু শি কিংবা পুতিন কেন, ট্রাম্পও এ পথের পথিক হতে পারেন। কিন্তু তারা তো এখন ভিন্ন পথে চলছেন। তাদের কর্ম, তাদের প্রোডাক্টিভিটি শুধু অশান্তি নয়, পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নৈতিক ও মানবিক পথে না চলার কারণে তারা পরস্পরের বন্ধু ভাবতে পারছেন না। ফলে আস্থার সংকট তাদের শত্রুতার পথে ঠেলে দিয়েছে। এর পরিণতি পরস্পরকে ধ্বংসের ‘মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতা’। পরাশক্তিগুলো ইতোমধ্যে আমাদের প্রিয় এই পৃথিবীটাকে বহুবার ধ্বংস করার মতো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু করার মতো যোগ্যতা চীন, রাশিয়া এবং আমেরিকা অর্জন করে ফেলেছে।

এমনই যখন পৃথিবীর অবস্থা, তখন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ৮০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে এক বিশাল কুচকাওয়াজের আয়োজন করলো চীন। এ উদযাপনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে আমন্ত্রণ জানালো চীন। তবে এ আমন্ত্রণের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে বেইজিং। ৪ সেপ্টেম্বর এ কথা জানান চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন। যুক্তরাষ্ট্র কি চীনের একথা বিশ^াস করলো? বিশাল ওই কুচকাওয়াজের পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’’ একটি পোস্ট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাতে তিনি লেখেন, ‘ভøাদিমির পুতিন ও কিম জন উনকে আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাবেন, যখন আপনারা মিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন’। ভাষার প্রয়োগ দেখে উপলব্ধি করা যায়, তাদের শত্রুতা কোন স্তরে অবস্থান করছে। কথামালা কিংবা কূটনৈতিক চাতুর্য দিয়ে এই সংকটের সমাধান হবে না। এর জন্য প্রয়োজন কাজ, সঠিক কাজ। কিন্তু তেমন লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।

চীনে শি, পুতিন ও কিমের সাক্ষাতের সমালোচনা করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাজা কালাসও। তার মতে, পশ্চিমাবিরোধী ‘নতুন বিশ^ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার অংশ হিসেবে তিন নেতা সাক্ষাৎ করেছেন। এটি বিভিন্ন নিয়মনীতির ওপর গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি সরাসরি একটি চ্যালেঞ্জ। এদিকে কাজা কালাসের মন্তব্য প্রসঙ্গে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, ওই ব্যক্তিরা তাদের কূপম-ুক ধারণা ও অহঙ্কার ত্যাগ করবেন। আর এমন কাজ বেশি করবেন, যা বিশ^শান্তি এবং চীন-ইউরোপ সম্পর্কের জন্য সহায়ক হয়।’ পরস্পরের প্রতি ভাষা প্রয়োগের চিত্র থেকে উপলব্ধি করা যায়, তারা কেউ কারো বন্ধু নন। অস্ত্রের তেজস্ক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে ভাষার বারুদও। পরাশক্তিবর্গের আচার-আচরণ মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। বিশ^ব্যবস্থা, নতুন বিশ^ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এসব শব্দ এখন আর মানুষকে আকৃষ্ট করে না। আসলে ‘বিশ^ব্যবস্থা’ কখনো গড়েই ওঠেনি। গড়ে ওঠেছিল নিজের ব্যবস্থা, নিজেদের ব্যবস্থা। এভাবে গড়ে ওঠেছিল এক ভ্রষ্ট সভ্যতাও, যার বড় শিকার ফিলিস্তিন। পরাশক্তিবর্গ কি এখনো যার যার মতো করে ‘নতুন বিশ^ব্যবস্থা’র কথা বলে যাবে? এমন কথা বলার যোগ্যতা কি তাদের কখনো ছিল? নিজেদের পরিবর্তনের যোগ্যতাও কি তাদের আছে?