আন্দোলনকারীদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন পলাতক আসামীদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ব্যারিস্টার ইশরাত জাহান।

গতকাল রোববার মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া পুলিশের ওসি মো. নূরে আলম সিদ্দিককে জেরার সময় এ দাবি করেন তিনি। ১৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে এই পুলিশ কর্মকর্তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যদের বিচারিক প্যানেল। অপর সদস্য হলেন- জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।

জেরার একপর্যায়ে ওসি নূরে আলমের উদ্দেশ্যে ইশরাত বলেন, ওই যুবক (আবু সাঈদ) যখন গুলীবিদ্ধ হন, তখন আপনি বা আপনারা কোথায় ছিলেন।

নূরে আলম বলেন, আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটের ভেতরে ছিলাম। এসি আরিফুজ্জামান স্যারও ছিলেন। তবে গেট খোলা ছিল।

পাল্টা প্রশ্ন করে আইনজীবী বলেন, আপনি বলেছিলেন গুলী বা হামলা করার সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন রংপুর কোতোয়ালি জোনের তৎকালীন এসি মো. আরিফুজ্জামান ও তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম। জবাবে হ্যাঁ বলেন সাক্ষী।

তখন আইনজীবী বলেন, তাদের নির্দেশে আবু সাঈদকে গুলী করা হয়েছিল বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। এ নির্দেশটি কি আপনি শুনেছেন। তখনও হ্যাঁ জবাব দেন নূরে আলম।

আইনজীবী ইশরাত আরও বলেন, দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক গুলীবিদ্ধ হওয়ার পেছনে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা ছিল না। আন্দোলনকারীদের ছোড়া ইটপাটকেল তার মাথার পেছনে লেগেছিল। এজন্য রক্তক্ষরণে তিনি মারা গেছেন।

জবাবে এসব সত্য নয় বলে জানান ওসি নূরে আলম সিদ্দিক। এরপর তাকে জেরা করেন আরেক আইনজীবী।

এদিন বিকেল ৩টার পর থেকে ৫টা পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে ট্রাইব্যুনালে। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে রংপুরের হারাগাছ থানায় কর্মরত ছিলেন নূরে আলম। আবু সাঈদ হত্যাকা-ের দিন তথা ১৬ জুলাই সকালে সঙ্গীয় বাহিনী নিয়ে রংপুর পার্কের মোড়ে আসেন তিনি। ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল তাকে। জবানবন্দীতে সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা ট্রাইব্যুনালের সামনে আনেন নিরস্ত্র এই পুলিশ কর্মকর্তা। এসি আরিফুজ্জামান ও তাজহাট থানার তৎকালীন ওসি রবিউল ইসলামের নির্দেশে আমির হোসেন ও সুজনরা গুলী চালিয়েছেন বলেও জানান। আর তাদের গুলীতে আহত হন আবু সাঈদ। গুলীবিদ্ধ হওয়ার মুহূর্তে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেন আরিফুজ্জামান স্যার। পরে ছাত্র-জনতা অন্যদিকে চলে যান বলেও উল্লেখ করেন নূরে আলম।

জবানবন্দীর প্রায় শেষের দিকে কিছুটা সংশোধনী দিতে চান এই পুলিশ কর্মকর্তা। অর্থাৎ বেরোবির গেটের ভেতরে থাকা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কথা উল্লেখ করেন। তখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন আরও কেউ ছিলেন কিনা, জানতে চায় প্রসিকিউশন।

এ সময় আপত্তি জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো। তিনি ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার এখানে আপত্তি যাবে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল। এখানে এই সংশোধন সাক্ষীর নয়, প্রসিকিউশনের। আর কেউ আসছেন কিনা, গেছেন কিনা; এমন কথা তারা বলতে পারেন না।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৮ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৭ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। আর কয়েকজনের জবানবন্দী নিয়েই সাক্ষ্য কার্যক্রম সমাপ্ত করবে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন। এ মামলার গ্রেপ্তার ছয় আসামী হলেন- এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। তাদের উপস্থিতিতেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন সাক্ষীরা।

গত ২৭ আগস্ট সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ৬ আগস্ট ৩০ আসামির বিরুদ্ধে ফর্মাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে, এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসিসহ ২৪ জন এখনও পলাতক রয়েছেন। তাদের পক্ষে গত ২২ জুলাই সরকারি খরচে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।