খুলনাকে আধুনিক নগরীর রূপ দিতে খুলনা সিটি কর্পোরেশন, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, সড়ক ও জনপদ বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো শহরে সারা বছর উন্নয়নের কার্যক্রম চলমান রেখেছে। তবে সারা শহরে সংশ্লিষ্টদের এই উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ অনেকাংশে নগরবাসীর গলারকাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা বছর ধরে সমগ্র শহরের অধিকাংশ স্থানে খোঁড়াখুঁড়িতে দিশেহারা নগরবাসী। খুলনার গুরুত্বপূর্ণ সড়কসহ স্থানীয় এলাকাগুলোর জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ বা সংস্কার, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিবিধ উন্নয়ন কার্যক্রমের খোঁড়াখুঁড়ি কার্যক্রম বলতে গেলে সারা বছরই ধরে চলে। চলমান এই উন্নয়ন কার্যক্রম খুলনার উন্নয়নের অবদান রাখলেও সারা বছর শহর জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তি যেন নগরবাসীর পিছু ছাড়ছেনা। বিশেষ করে বর্ষা মওসুমে এই ভয়াবহতা আরো বাড়ছে।
খুলনা মহানগরবাসী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্প মানুষের স্বস্তির জন্য, ভোগান্তির জন্য নয়। কিন্তু খুলনা মহানগরীতে দীর্ঘ সময় ধরে উন্নয়ন প্রকল্পের যে কাজ চলামান রয়েছে তা নগরবাসীর স্বস্তির বিপরীতে দুর্ভোগ বহুগুণে বাড়াচ্ছে। এতে শহরে স্বাভাবিক চলাচল ব্যহত হচ্ছে, বিশেষ করে বর্ষায়।
নাগরিক নেতা সৈয়দ আলী হাকিম বলেন, অপরিকল্পিত উদ্যোগ ও সমন্বয়হীনতার কারণেই সমগ্র শহরে বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি লেগেই থাকে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ণে দীর্ঘসূত্রিতা ও সমন্বয়হীনতা ও দায়বদ্ধহীনতার কারণে সময় এবং অর্থ দুটোই অপচয় হচ্ছে। নগরবাসীর স্বস্তি ফেরাতে শহরের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে স্বাভাবিক চলাচল অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নাগরিক নেতৃবৃন্দসহ ভোগান্তির শিকার নগরবাসী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নগরীতে ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৩ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার মধ্যে সরকারি অর্থায়ণে ২টি ও নিজস্ব অর্থায়ণে ১টি প্রকল্প বাস্তবায়ণ হচ্ছে। এর মধ্যে, ২৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পটি গত ২০১৩ সালে অনুমোদন পেলেও জমি বুঝে পেতে বিলম্ব হওয়ায় কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। বর্তমানে কাজটির কার্পেটিং লেয়ার, বেজ লেয়ার ও ব্রীজের সুপার স্ট্রাকচারের আংশিক কাজ চলমান রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে কাজটি সম্পন্ন হবে, বর্তমানে কাজের অগ্রগতি ৭৫%। ৭১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে থ্রী-লিংক সড়ক নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয় গত ২০১৮ সালের শেষের দিকে, শেষ হওয়ার কথা রয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে। থ্রী-লিংক সড়কের ৩টি অংশ যথাক্রমে-আড়ংঘাটা থানাধীন গাইকুড় থেকে বাস্তহারা লিংক রোড পর্যন্ত, আরেকটি অংশ নগরীর রায়েরমহল হতে গল্লামারী পর্যন্ত এবং শেষ অংশটি নগরীর নিরালা মোড় থেকে সিটি বাইপাস পর্যন্ত কাজ চলমান রয়েছে, তিন সড়কের অগ্রগতির গড় ৬০%।
খুলনা ওয়াসা ২ হাজার ৩’শ ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ১৭-৩১ নং ওয়ার্ডে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রেখেছে, কাজের অগ্রগতি ৬৫%। প্রকল্পটি গত, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুমোদন পেলেও ঠিকাদার নিয়োগে জটিলতা, করোনা সংক্রমনসহ বিবিধ বিষয়ের জটিলতার পর মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয় গত, ২০২২ সালের অক্টোবর মাস থেকে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে চলমান কাজ শেষ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খুলনা মহানগরীর ভৈরব নদীর উপর (দৌলতপুর-দিঘলিয়া এলাকায়) ৩০২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভৈরব সেতু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া গল্লামারী এলাকায় খুলনা সড়ক বিভাগ গল্লামারি ব্রীজের কাজ চলমান রেখেছে। ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ব্রীজের কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজটি গত, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে অনুমোদন পেয়ে টেন্ডার, ঠিকাদার নিয়োগ শেষে কাজ শুরু হয়েছে অক্টোবর মাস হতে। আশা করা যাচ্ছে আগামী ২০২৬ সালের জুন মাসে ব্রীজের চলমান কাজ শেষ হবে। এছাড়া নগরীর বৈকালি স্টেডিয়াম সম্মুখে সূয়ায়েজ ড্রেনের (ক্রস ড্রেন)’র কাজও শেষের দিকে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এডভোকেট বাবুল হাওলাদার জানান, উন্নয়নের নামে সারা বছর জুড়ে খুলনা শহর জুড়ে যে খোঁড়াখুঁড়ি এতে জনভোগান্তি চরমে এটা বিষয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। কেবল নগরবাসী নয়, বাইরে জেলা-শহর থেকে যারা খুলনা শহরে বসবাস করেছেন সবাই চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। উন্নয়ন প্রকল্প মানুষের স্বস্তির জন্য, ভোগান্তি দূর করার জন্য। কিন্তু খুলনা মহানগরীতে দীর্ঘ একযুগ যে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে তা জনগণের স্বস্তির বিপরীতে দুর্ভোগ বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।
সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র খুলনা মহানগর সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট কুদরত-ই খুদা বলেন, প্রথমত, খুলনায় সারা বছর ধরে জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়ে বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়নের যে কর্মকান্ড চলে, আমার ভাষায় এটি একটি অপরিকল্পিত উদ্যোগ। দ্বিতীয়ত, দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। যে যখন ইচ্ছা তখন শহরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে উন্নয়নের কাজগুলো করছে। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকলে, দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে তারা স্বেচ্ছায় সমান্বয় করে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। প্রতিটি কাজের একটা মওসুম আছে, মেয়াদ আছে। বিশেষ করে শুকনা মওসুমে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কাজ সম্পন্ন করলে জনগণের দুর্ভোগ কমবে। যারা সরকারি, সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, তারা নিজেদের জনগণের কর্মী মনে করেন না, এ কারণে শহর থেকে অপরিকল্পিত উদ্যোগে জনগণের দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছেনা, কারণ তারা জনগণের কথা ভাবলে, আগেই দুর্ভোগের কথা ভাবতেন।
খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাহবুব ব্রার্দাসের প্রকল্প ম্যানেজার (পিএম) মো. আশরাফ আলী জানান, বর্ষার কারণেই আমাদের কাজ বন্ধ রয়েছে। বর্ষা কমলেই আমরা কাজ শুরু করবো। আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে সড়ক দৃশ্যমান হবে বলে আশা রাখি। জনদুর্ভোগ কমাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশা রাখি।
খুলনা ওয়াসার প্রকল্প পরিচালক খান সেলিম আহম্মদ জানান, চলাচলে একটু সাময়িক দুর্ভোগ হলেও নগর ও নগরবাসীর উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। খুলনার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বর্ষার জন্য চলমান কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কেডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রকল্প) মোরতোজা আল মামুন জানান, শিপিয়ার্ড সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচলে যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, খুলনার একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অফিসিয়ালি কিছু কিছু পর পর ঠিকাদারকে ডাকা হচ্ছে, সর্তককরণ করা হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে শিপইয়ার্ড সড়কে কাজ সম্পন্ন করা জন্য। তিনিও আশ^স্ত করছেন যথাসময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করা জন্য। আমাদের প্রত্যাশা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঠিকাদার কাজটি সম্পন্ন করে হস্তান্তর করবে। তারপরও যদি যাদের বিলম্ব হয়, সার্বিক বিষয়ে মন্ত্রনালয় সিদ্ধান্ত নিবে।
এ ব্যাপারে কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী খান মশিউজ্জামান বলেন, উন্নয়ন কার্যক্রমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। বিষয়টি বিবেচনা করে ওয়াসাকে চলতি বর্ষা মওসুমে রাস্তা খোড়াখুড়ি না করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। জনদুর্ভোগ এড়াতে সমান্বয়ের মাধ্যমে ওয়াসা কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্থ কেডিএ এ্যাপ্রোচ সড়ক ও দোলখোলা সাতরাস্তা মোড় কেসিসি ঠিকাদারের মাধ্যমে দ্রুত কাজ শেষ করা হচ্ছে। এছাড়া বর্ষার জন্য অধিকাংশ ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।