পার্বতীপুর (দিনাজপুর) সংবাদদাতা : পাঁচ বছরে ১৫ কোটি টাকার বেশী ব্যাংক লেনদেন, ঢাকা ও বগুড়ায় একাধিক বাড়ীসহ বিপুল পরিমাণ বিত্ত বৈভবের মালিক বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মোঃ সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ তদন্ত করছে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মোঃ আব্দুল মান্নান পাটওয়ারীর নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (জিএম-পরিকল্পনা কৌশল) প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ সাহা, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম-অর্থ) মোঃ শাহীন উদ্দিন প্রামানিক ও ডিজিএম (উৎপাদন ও বিপণন) ড. মোঃ বেলায়েত হোসেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বছরের ৭ নবেম্বর গঠিত তদন্ত কমিটিকে ২০ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে সময় দিয়েছিল পেট্রোবাংলা। কিন্তু সাড়ে তিন মাসেও তদন্ত প্রতিবেদন দেয়নি কমিটি। উল্লেখ্য, গত বছরের ২, ১০, ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর জোবায়দুর রহমান ও মোর্শেদ আলম নামে দুই ব্যক্তি এমডি সাইফুল ইসলামের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে পৃথক পৃথক অভিযোগ দাখিল করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দপ্তরে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (চলতি দায়িত্ব) দায়িত্ব দেওয়া হয় সাইফুল ইসলামকে। খনি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে সাইফুল ইসলাম এক সময় ইঞ্জিনিয়ার টু কন্ট্রাক্ট এর দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। চাইনিজ ঠিকাদার তাকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের মাইনিং ইকুইপমেন্ট আমদানি করতো। সাইফুল ইসলাম এমডি’র দায়িত্ব পেয়ে আরও ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাসে সাইফুল ইসলাম পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণাঙ্গ এমডি বনে যান।
বড়পুকুরিয়া খনির বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের কাছে প্রায় ১২ কোটি টাকা দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী থাকা সত্ত্বেও তিনি ওই ব্যাংকে ২০২৩ সালে আরও ২ কোটি টাকা এফডিআর করেন। এছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে চারটি বেসরকারী ব্যাংকে প্রায় ১১৭ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। ব্যাংক চারটি হলো-ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্যোসাল ইসলামি ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক। ব্যাংক খেকো এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসব ব্যাংকে রক্ষিত আনামত এখন ঝুঁকির মুখে। ছয়মাস মেয়াদী এসব স্থায়ী আমানত হিসাব খোলা ও নবায়নের ক্ষেত্রে তিনি একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন গ্রহণ করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। তবে কমিশন গ্রহণের কথা অস্বীকার করে এমডি জানান- উপর মহলের চাপে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর স্থানান্তর করা হয়।
খনির ২৪ তম বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) ব্যয় দেখানো হয় ৩৮ লাখ ৫ হাজার টাকা। এরমধ্যে খনির ১৮২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৯২০ টাকার বিছানার চাদর ও ছাতা ক্রয় দেখানোসহ ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে প্রায় ১৫ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়। কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিছানার চাদর বা ছাতা দেওয়া হয়নি। এসব বিলের ভাউচারগুলো এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ভাউচারগুলো যাচাই করে দেখা যায়- যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল ক্রয় করা হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব নেই। আউটসোর্সিং কর্মচারী হিসেবে ২৫ জনকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিধি অনুযায়ী কোম্পানীর প্রফিট বোনাসের টাকা এমডি’র পাওয়ার কোন সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও তিনি চাপ প্রয়োগ করে প্রফিট বোনাস হাতিয়ে নেন। ডেব্রিস (DEBRISS- খনি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত লোহা, কয়লা মিশ্রিত একধরনের পাথর) বিক্রিতে অভিনব কায়দায় কমিশন আদায় করে এমডি। যা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়। এমডি সাইফুল ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবস্থাপক আব্দুর রহমান এই টাকা কালেকশন করে যা ওপেন সিক্রেট। বগুড়া শহরের আজিজুল হক কলেজের পিছনে ৫ তলা বাড়ী, মিরপুর-২ এ বিলাসবহুল ফ্লাট ছাড়াও ফুলবাড়ীতে জায়গা কিনেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। এমডি সাইফুল ইসলামের ব্যক্তিগত একটি ব্যাংক হিসাব (সোনালী ব্যাংক, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি শাখা) নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ বছর ৪ মাসে ওই ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরে ১৫ কোটি ২৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৫০ টাকা লেনদেন করা হয়েছে। এরমধ্যে এক কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশী শুধু নগদ অর্থ জমা করা হয়েছে। অথচ এই সময়ের মধ্যে বেতনভাতাসহ অন্যান্য পারিতোশিক মিলে সাকুল্যে অর্ধকোটি টাকার বেশী তার বৈধ আয় হওয়ার কথা নয়। তদন্ত কমিটির প্রধান পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মোঃ আব্দুল মান্নান পাটওয়ারী জানান- মামলা সংক্রান্ত জঠিলতার কারণে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাচ্ছে না। এমডি প্রকৌশলী মোঃ সাইফুল ইসলাম সরকার অভিযোগগুলো অস্বীকার করে জানান-আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে উপরমহলের মৌখিক নির্দেশনায়। কোন উৎকোচের বিনিময়ে নয়। কোম্পানীর ২৪তম এজিএম-এ কেনাকাটাসহ যাবতীয় ব্যয় ও কার্য সম্পাদনের জন্য ৫ জন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করে।