শাহিনুর রহমান সুজন, চারঘাট (রাজশাহী): রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কালুহাটি পাদুকা পল্লী আজ নীরব। যেখানে ব্যবসায়ীর পদচারণায় মুখর থাকার কথা, সেখানে এখন তালাবদ্ধ ৮২টি কারখানার মধ্যে মাত্র ১১টি। ৬০-৬৫ কোটি টাকার ব্যবসা কমে মাত্র ২-৩ কোটিতে নেমে এসেছে, হাজারো শ্রমিক কাজ হারিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। রাজনৈতিক দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় পেরে না ওঠায় এই শিল্প আজ ধ্বংসে দ্বারপ্রান্তে।

১৯৮০ সালে বড়াল নদীর তীরে হাতে গড়া জুতা-স্যান্ডেল তৈরির পল্লী গড়ে ওঠে। তখন থেকে ধীরে ধীরে প্রসার ঘটে, ৮২টি কারখানায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, যার মধ্যে ২ হাজার ছিলেন নারী। কেবল রমজান মাসেই প্রায় ৬০-৬৫ কোটি টাকার জুতা বিক্রি হতো। দেশজুড়ে কালুহাটির হাতে তৈরি পাদুকার চাহিদা ছিল ব্যাপক। এমনকি একসময় এই গ্রামকে দেশের একমাত্র বেকারহীন গ্রাম হিসেবেও গণ্য করা হতো। গত কয়েক বছরে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান অত্যাধুনিক মেশিন ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাদুকা তৈরি করছে, যা হাতে তৈরি জুতার বাজারকে সংকুচিত করেছে। ক্রেতারা সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী দামের কারণে এসব কোম্পানির দিকে ঝুঁকছেন। ফলে কালুহাটির জুতার চাহিদা কমে গেছে। নিউ মান্নান সুজের মালিক আব্দুল মান্নান বলেন, “আগে দোকানিরা আমাদের কারখানা থেকে জুতা নিতো, এখন বড় কোম্পানিগুলো সরাসরি দোকানে পণ্য সরবরাহ করছে। এতে আমাদের মাল বেচা কঠিন হয়ে পড়েছে।”

২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ক্ষমতায় আসার পর কালুহাটি পাদুকা পল্লী ধীরে ধীরে সংকটে পড়তে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকতে কারখানা মালিকরা ছোট মেশিন কেনার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ঋণের আবেদন করেন। এই সুযোগে প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা কামাল হোসেন ও তার ভাগিনা সোহেল রানা কারখানা না থাকলেও পাদুকা সমবায় সমিতি গঠন করে কারখানা মালিকদের নামে সরকারি ব্যাংক ও এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ উঠে। করোনা মহামারির সময়ও তারা সরকারের দেয়া আর্থিক সুবিধা নিজেরা ভোগ করেন। ফলে প্রকৃত কারখানা মালিকরা ঋণ না পাওয়ায় ব্যবসা সংকটে পড়ে। শিশির সুজের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমি ৫ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করেছি, কিন্তু নতুন ঋণ পাইনি। তাই ব্যবসা বন্ধ করে অন্য জায়গায় চাকরি করছি।” শিল্প মন্ত্রণালয়ের এসএমই ফাউন্ডেশন কালুহাটির উন্নয়নে ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৩টি আধুনিক মেশিনসহ দেশের প্রথম কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার (সিএফসি) স্থাপন করে। কিন্তু সেটিও রাজনৈতিক স্বার্থের শিকার হয়। প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে যুবলীগ নেতা কামাল হোসেন বিএনপি সমর্থিত এক ব্যক্তির দখলকৃত জমিতে জোরপূর্বক সিএফসি স্থাপন করেন। পরে সরকার পরিবর্তনের পর বিএনপি সমর্থকরা সেটি দখলে নেয় এবং ভাংচুর চালায়। এখন সিএফসি তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আধুনিক মেশিন ব্যবহার করে জুতা তৈরির সুযোগ পেলেও রাজনৈতিক দখলদারির কারণে সেটি অকেজো হয়ে আছে। পাদুকা পল্লীর শিল্প বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দখলদারি। সরকারি ঋণসহায়তা কালুহাটি পাদুকা শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। কিন্তু বর্তমানে ঋণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কারখানাগুলো চালু রাখতে মালিকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৮২টি কারখানার মধ্যে মাত্র ১১টি চালু আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকার পরও সিএফসি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। অধিকাংশ শ্রমিক কাজ হারিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে প্রকৃত কারখানা মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কালুহাটির পাদুকা শিল্প বাঁচাতে প্রকৃত কারখানা মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান নিশ্চিত করা, কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার চালু করে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের সুযোগ দেয়া, সরকারি অনুদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা বাড়ানো এবং বড় কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতার মুখে টিকে থাকতে বিকল্প বাজার তৈরি করা প্রভৃতি উদ্যোগ নিতে হবে বলে স্থানীয়রা মনে করেন।