শেয়ার বাজার থেকে অর্থ লোপাট, প্রতারণা ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে করা মামলায় ক্রিকেটার ও মাগুরা-১ সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশের সফলতম এই ক্রিকেটারকে আগামী ২৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়ে তাকে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
দুদকের এই মামলায় মোট ১৫ জনকে আগামী ২৫ ও ২৬ নভেম্বর পৃথক দিনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গেল ১৭ মে দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন বাদী হয়ে শেয়ার বাজারে অর্থ লোপাটের মামলাটি দায়ের করেন। ১৬ জুন আদালত তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়।
মামলার অপর আসামীরা হলেন- সাকিবের মা শিরিন আক্তার, সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক আবুল খায়ের,তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, আবুল কালাম মাদবর, কনিকা আফরোজ, মোহাম্মদ বাশার, সাজেদ মাদবর, আলেয়া বেগম, কাজী ফুয়াদ হাসান, কাজী ফরিদ হাসান, জাভেদ এ মতিন, জাহেদ কামাল, হুমায়ূন কবির ও তানভীর নিজাম।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তারা নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্টসমূহে অসাধু, অনৈতিক ও অবৈধ উপায়ে ফটকা ব্যবসার মত ধারাবাহিক লেনদেন, প্রতারণামূলক সক্রিয় লেনদেন, ফাটকা ও অনুমাননির্ভর লেনদেনের মাধ্যমে বাজারে কারসাজি করত। তারা একটি সংঘবদ্ধ চক্র গঠন করে নির্দিষ্ট কিছু শেয়ারে ধারাবাহিকভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি করে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সেই শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করত। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হন এবং চক্রটি ২৫৬ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৩০৪ টাকারও বেশি আত্মসাৎ করে, যা অস্বাভাবিক মূলধন লাভ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ছিল অপরাধলব্ধ অর্থ।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, এ ধরনের বাজার কারসাজির ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ২৫৬ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৩০৪ টাকা ক্ষতির শিকার হয়েছেন এবং ওই অর্থ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া শেয়ারবাজার থেকে অর্জিত অস্বাভাবিক ক্যাপিটাল গেইন বিভিন্ন খাতে স্থানান্তর করে উৎস গোপন করার অভিযোগও রয়েছে। এতে আবুল খায়েরের স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানও সহযোগিতা করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্যাপিটাল গেইনের নামে ২৯ কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ১৮৫ টাকা স্থানান্তরের তথ্যও মামলায় যুক্ত আছে।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক মো. আবুল খায়ের ওরফে হিরুর ১৭টি ব্যাংক হিসাবে ৫৪২ কোটি ৩১ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ টাকা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর গত ১৭ জুন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও দ-বিধির বিভিন্ন ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
দুদক বলছে, মো. আবুল খায়ের (ওরফে হিরু) শেয়ারবাজার থেকে তোলা অর্থ থেকে ২৯ কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ১৮৫ টাকা তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানের সহায়তায় বিভিন্ন খাতে স্থানান্তরের মাধ্যমে ‘মানি লন্ডারিং’ করেন। হিরুর নামে থাকা ১৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫৪২ কোটি ৩১ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২টাকার ‘অস্বাভাবিক, অযৌক্তিক এবং সন্দেহজনক’ লেনদেন হওয়ার কথাও বলা হয়েছে মামলার এজাহারে। সেখানে বলা হয়েছে, হিরুর কারসাজি করা প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এবং সোনালী পেপারস লিমিটেডের শেয়ারে সাকিব আল হাসান বিনিয়োগ করেন। এতে তিনি মার্কেট ম্যানিপুলেশনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওই কারসাজিকৃত শেয়ারে বিনিয়োগে প্রতারণার মাধ্যমে প্রলুব্ধ করে তাদের ২ কোটি ৯৫ লাখ ২ হাজার ৯১৫ টাকা রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইনের নামে অপরাধলব্ধ আয় হিসেবে শেয়ার বাজার হতে উত্তোলনপূর্বক আত্মসাৎ করেন। এই প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দরে কারসাজির অভিযোগেই গত সেপ্টেস্বরে সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা জারিমানা করেছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সে সময় আবুল খায়ের ওরফে হিরুকে ২৫ লাখ টাকা, ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ৭৫ লাখ টাকা, মোনার্ক মার্ট লিমিটেডকে এক লাখ টাকা, আবুল কালাম মাতবরকে ১০ লাখ টাকা, লাভা ইলেক্ট্রোড ইন্ডাস্ট্রিজকে এক লাখ টাকা এবং জাহেদ কামালকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছিল বিএসইসি।
মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে দুদক এজাহারভুক্ত ১৫ আসামীকে তলব করেছে। তাদের মধ্যে ২ নম্বর আসামী সাকিব আল হাসানকে ২৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হতে বলা হয়েছে। দুদক বলছে, সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগেও পৃথক অনুসন্ধান চলছে। একই দিন ও সময়ে ওই অভিযোগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সাকিব আল হাসান ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাগুরা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অগাস্টে তিনি যখন কানাডায়, সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর তার আর দেশে ফেরা হয়নি।