সাইফুল ইসলাম, ঝিনাইদহ সংবাদদাতা : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়েন ঝিনাইদহের জামায়াত নেতা মাসুদুর রহমান মাসুদ। ডিজিএফআইএর আয়নাঘরে বন্দী রেখে দীর্ঘ সাড়ে ছয় মাস তাকে করা হয় অকথ্য নির্যাতন। ছয় দিন পান করার জন্য দেওয়া হতো ১ লিটার পানি। খাবারও দেওয়া হতো যৎসামান্য। বন্দী অবস্থায় নামায পড়তে পারেন নি এক দিনও। দেওয়া হয়নি রোজা রাখার সুযোগও।

আয়নাঘরে রোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার মাসুদ সম্প্রতি দৈনিক সংগ্রামকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান। মাসুদ ঝিনাইদহের আলহেরা ইসলামী ইনস্টিটিউটের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং সদর উপজেলার কালীচরণপুর ইউনিয়ন জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি। তাকে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট র‌্যাব আটক করে। এরপর তার জীবনে নেমে আসে আয়নাঘরের বিভীষিকাময় বন্দী জীবন। তাকে সেখানে বন্দী করে রাখা হয় ছয় মাস ১৪ দিন।

মাসুদ জানান, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। শহরের হামদহ শেখপাড়ায় স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে বসবাস করতেন। আটকের দিন সকালে মাগুরার মহম্মদপুরের নোহাটা বাজার এলাকায় খালু শ্বশুরের বাড়িতে নাশতা করছিলেন। এ সময় র‌্যাব পরিচয়ে তাকে আটক করে চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। প্রথমে নেওয়া হয় ঝিনাইদহ র‌্যাব ক্যাম্পে। তারপর তাকে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

এরপর সেখানে ব্যাপক নির্যাতন করা হয় জামায়াতের এ নেতাকে । তিনি বলেন, আটকের পর থেকে চোখ বাঁধা ও হাতে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় ঝিনাইদহ ক্যাম্পে সাত দিন নির্যাতন করা হয়। পরে ১৫ আগস্ট আমাকে ঢাকায় ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘরে স্থানান্তর করে র‌্যাব সদস্যরা। এরপর আমার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।

অশ্রুসজল নয়নে মাসুদ বলেন, ছয় দিন পান করার জন্য মাত্র এক লিটার পানি দেওয়া হতো। বাথরুমে গিয়ে ট্যাপের পানি খাওয়ারও কোনো উপায় ছিল না। কারণ বাথরুমে গেলেও সঙ্গে গার্ড থাকত। চোখের বাঁধন লাগানো থাকত সব সময়। একটু এদিক সেদিক করলেই করা হতো ব্যাপক মারধর।

মাসুদ আরও জানান, আয়নাঘরে ঠাঁই হওয়ার দুদিনের মাথায় তার হাতের ১০ আঙুলের নখ প্লাস দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। লম্বায় ৫ ফুট ও প্রস্থে দেড় ফুট অন্ধকার কুঠুরিতে প্রতিদিন তাকে তিনবার নিয়ম করে মারধর করা হতো।

৫৫ বছর বয়সী জামায়াত নেতা মাসুদ বলেন, প্রতিদিন প্রথম মারধরের সময় দুই পায়ে গুনে গুনে বেতের লাঠি দিয়ে ৬০ বার আঘাত করত নির্যাতনকরীরা। চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো অবস্থায় প্রতিদিন সকালে একটি করে আটার রুটি দেওয়া হতো খাওয়ার জন্য। দুপুরে দিত মাত্র এক কাপ ভাত, সঙ্গে দুই টেবিল চামচ পরিমাণ সবজির তরকারি।

আটকের সময় ৯২ কেজি ওজন ছিল মাসুদের। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যান। তিনি বলেন, ঠিকমতো খেতে না পাওয়ার কারণে ১৫-১৭ দিন পর ইটের খোয়ার মতো এক টুকরো মলত্যাগ হতো। আর প্রস্রাব হতো দুই থেকে তিন দিন পর তাও সামান্য।

আয়নাঘরে মাসুদ কখনো নামায পড়তে পারেননি উল্লেখ করে বলেন, একবার নামায পড়ার ইচ্ছা হলে তাদের বলি। তখন আমাকে স্যান্ডেল দিয়ে মাথায় বেধড়ক পেটানো হয়। ফলে আমি জ্ঞান হারাই। রোজা রাখতে পারিনি কখনো। হাতে সব সময় হাতকড়া লাগানো থাকায় আমার দুই হাতের কব্জিতে পচন ধরে একপর্যায়ে। তবু হাতকড়া খুলে দেয়নি ফ্যাসিস্টের দোসররা। নির্যাতনে অনেকেই মারা গেছেন। তিন থেকে চারটি লাশ হলে তারপর গাড়ি আসত এগুলো সরিয়ে নিতে। অনেক সময় লাশ পচে দুর্গন্ধ বের হতো।

উদাস কণ্ঠে মাসুদ বলেন, আয়নাঘরের নির্যাতন যুদ্ধের বর্বরতাকেও হার মানায়। আটক হওয়ার এক সপ্তাহ আগে বড় মেয়েকে কুষ্টিয়ায় বিয়ে দিই। বিয়ের রাতেই ঝিনাইদহ র‌্যাব কুষ্টিয়ায় গিয়ে মেয়েজামাই মোস্তফা কামালকে আটক করে নিয়ে আসে। আমি আটক হওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয় র‌্যাব। গ্রেপ্তার এড়াতে আমি প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আটকের পর শুরু হয় র‌্যাব ও পুলিশের আসল অর্থ বাণিজ্য। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের মাঝরাতে বাড়িতে এসে টাকার জন্য ভয় দেখানো হতো। বলা হতো টাকা না দিলে আমাকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। প্রায় ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে আমি ছাড়া পাই। এ অর্থ জোগাড় করা হয়েছে জমি ও গরু বিক্রি করে।

মাসুদ জানান, ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টায় চোখ বেঁধে পুরান ঢাকার মোগলটুলি এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা হাতে দিয়ে তাকে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয়দের সহযোগিতায় তিনি বাড়িতে ফেরেন। এ সময় তার ওজন হয়েছিল ৫০ কেজি। আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আটক হওয়ার তিন মাসের মাথায় আমার ছোট ভাই ঝিনাইদহ আলিয়া মাদরাসার ছাত্রশিবিরকর্মী কামরুল ইসলামকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে। এখনো পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি।