বহুল আলোচনা-সমালোচনার পর অবশেষে খুলনা নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. সেখ মো. এনায়েতুল বাবর পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে শনিবার ব্যক্তিগত কারণে দায়িত্ব পালনে ইচ্ছুক নন উল্লেখ করে পদত্যাগ করেন তিনি। এর আগে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন এলেও বেসরকারি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে রয়ে যায় ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিয়ন্ত্রণ। একই সাথে ফ্যাসিবাদের দোসর ভিসি ও রেজিস্ট্রারের পদত্যাগসহ কয়েকজন ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যের পরিবর্তনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলতে থাকে। গত বৃহস্পতিবারও রেজিস্ট্রার ড. সাহিদা খানমের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিল শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সূত্র জানায়, ট্রাস্টি ও চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এনডব্লিউইউ/রেজি./বিজ্ঞপ্তি/২০২৫/১৩ স্মারকে শনিবার ভিসি প্রফেসর ড. সেখ মো. এনায়েতুল বাবর পদত্যাগ করায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৩১ (৬) ধারা অনুযায়ী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার কানাই লাল সরকার সাময়িকভাবে ভাইস-চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করবেন।
সূত্রমতে, ২০১২ সালে খুলনা নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি যাত্রা শুরু করে। সূচনালগ্ন থেকেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি কর্পোরেশনের অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। তার পাশে ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা-৩ আসনের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তনের হাওয়া বইলেও বোর্ডের কাঠামোয় তেমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেনি। পরে দায়সারা ভাবে শুধু পরিবর্তন করা হয় চেয়ারম্যান, কিন্তু পুরনো প্রভাবশালী দুই নেতাকে ট্রাস্টি সদস্য রেখেই সাজানো হয় নতুন বোর্ড।
জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া খুলনার শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, দেশের অন্যান্য স্থানে যখন ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল, তখনো খুলনায় শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। তবে ৩০ জুলাই রাতে খুলনা সার্কিট হাউজে কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে জীবননাশের হুমকি দেন তালুকদার আব্দুল খালেক ও এস এম কামাল হোসেন। সেই সময়ে তারা পুলিশকে ছাত্রদের ওপর গুলি করার সুপ্রিম নির্দেশও দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ড. সেখ মো. এনায়েতুল বাবর ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি এ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক। ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তাকে নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়োগ পাওয়ার জন্য এনায়েতুল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে জীবন বৃত্তান্ত পাঠিয়েছিলেন, তাতে নিজেকে আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে চাকুরি জীবনে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের খুলনা মহানগর কার্যনির্বাহী পরিষদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। জীবন বৃত্তান্তে লেখা হয়েছে, ড. এনায়েতুলের ফুফাতো ভাই এডভেকেট সাইফুল ইসলাম খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, তার খালা মহানগর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক হালিমা ইসলাম। এ ছাড়া তার এই নিয়োগের জন্য তৎকালীন ট্রাস্টি বোর্র্ডের চেয়ারম্যান তালুকদার আব্দুল খালেকের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল বলে জানা গেছে।
একাধিক সূত্র বলছেন, ট্রাস্টি তৌহিদুল ইসলাম আজাদ শেখ বাড়ির ও সাবেক পলাতক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রভাবে জমি কেনা, বালু ভরাট ও বিভিন্ন কাজে ব্যাপক অনিয়ম করে ইউনিভার্সিটি থেকে কোটি কোটি লুটপাট করেছিলেন। পটপরিবর্তন হওয়ার পর দুর্নীতি প্রকাশের আতঙ্কে ভুগছেন তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি তৌহিদুল ইসলাম আজাদের ব্যবহৃত মোবাইলে (০১৭১১ ৫২১৫১৪) কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান এবং ট্রাস্টি ও সচিব সৈয়দ হাফিজুর রহমান এসব বিষয়ে এখনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তারা। এসব বিষয়ে জানতে সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সিরাজুল হক চৌধুরীর মোবাইলে কথা দিলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনা শাখার সভাপতি এডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, স্বৈরাচারের দোসররা এই প্রতিষ্ঠানে থাকলে তা কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। গত এক যুগে তারা একযোগে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। এদের অবিলম্বে এসব পদ থেকে সরিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হোক। আর শিক্ষার্থীদের টাকা এখনো স্বৈরাচারদের পকেটে যাবে এটা মানা যায় না। এ বিষয়ে ইউজিসিকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।