শৈলকুপা (ঝিনাইদহ) সংবাদদাতা: ঝিনাইদহের শৈলকুপায় থামানোই যাচ্ছে না ভেজাল পশুখাদ্যের বাজারজাত। ভেজাল পশুখাদ্যের এক অশুভ চক্র জাঁকিয়ে বসেছে, যা কেবল খামারিদের প্রতারিত করছে না, বরং জনস্বাস্থ্য এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পচা চাল, গম, ধানের কুঁড়া এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ আটার বিষাক্ত মিশ্রণে তৈরি এসব পশুখাদ্য শুধু প্রাণীদের অসুস্থ করে তুলছে না, মানুষের খাদ্যচক্রেও বিষ ছড়াচ্ছে।
শৈলকুপার কবিরপুরে গো-হাটের সামনে অবস্থিত একটি গুদাম এই জঘন্য প্রতারণার মূল কেন্দ্রবিন্দু। রাতের আঁধারে, বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দরজার আড়ালে, পচা ও নি¤œমানের উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব ভেজাল গো খাদ্য। মোবাইল কোর্টের অভিযান ও জরিমানা যেন এদের কাছে নিছকই ছেলেখেলা!
খামারিরা নিরন্তর ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তাদের গরু অসুস্থ হচ্ছে, দুধ উৎপাদন ভয়াবহভাবে কমে যাচ্ছে। ভেজাল গো খাদ্যকে নামীদামী কোম্পানির মোড়কে বাজারজাত করে এরা একদিকে যেমন সাধারণ খামারিদের সর্বস্বান্ত করছে, তেমনি অন্যদিকে মানুষের পেটে বিষাক্ত মাংস ও দুধ তুলে দিচ্ছে। গুদামের ভেতরে বসে মেশিন দিয়ে পচা চাল, গম, কুঁড়া এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ আটা মিশিয়ে প্রকাশ্যে এই অপকর্ম চলছে। শ্রমিকরাও স্বীকার করছে, দীর্ঘদিন ধরে তারা এই ভেজাল কারবারে জড়িত। এমনকি খুলনা ও কুচ্ছিার রেজিস্টার্ড কোম্পানির গোখাদ্যের সাথে ভেজাল মিশিয়ে বাজারজাত করার মতো ঘৃণ্য অপকৌশলও তারা অবলম্বন করছে।
হাবিবপুরের খামারি মিঠুর মতো শত শত খামারি ভেজাল গোখাদ্যের কারণে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। তাদের উদ্বেগ সুস্পষ্ট: যদি এই ভেজাল বন্ধ না হয়, তাহলে দুগ্ধ খামার শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলামের কথায় হতাশা স্পষ্ট: “কয়েকবার মোবাইল কোর্ট হয়েছে, মোটা অংকের জরিমানাও হয়েছে, কিš‘ তারপরও এদের লাগাম টানা যাচ্ছে না। আমরা চাই এই গোডাউন চিরতরে বন্ধ হোক।”
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার রাসেল আহমেদ স্বীকার করেছেন যে, লাইসেন্স ছাড়া গোখাদ্য উৎপাদন সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অন্যের স্টিকার ব্যবহার করাও গুরুতর অপরাধ।তিনি আরো বলেন ভেজাল গোখাদ্য পশুপালন খাত এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। এর কারণে সৃষ্ট ক্ষতি বহুমাত্রিক এবং সুদূরপ্রসারী। ভেজাল খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে না। পচা চাল, গম, কুঁড়া, বাসি আটা ইত্যাদিতে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অভাব থাকে, যা পশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এতে পশু দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।ভেজাল বা বিষাক্ত উপাদানযুক্ত খাদ্য পশুর হঠাৎ মৃত্যুর কারণও হতে পারে, যা খামারিদের জন্য বিশাল আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়।
ভেজাল খাদ্যে ব্যবহৃত পচা উপাদান, রাসায়নিক পদার্থ (যেমন ফরমালিন, রঙ, বা মেয়াদোত্তীর্ণ আটা) পশুর দেহে জমা হয় এবং দুধ ও মাংসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এর ফলে পেটের পীড়া, বমি, ডায়রিয়া, এবং অন্যান্য হজমজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।নিয়মিত ভেজাল পণ্য গ্রহণের ফলে মানবদেহে বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকি বাড়ে। এর মধ্যে রয়েছে লিভার ও কিডনি অকার্যকর হওয়া, হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, রক্তশূন্যতা, এবং সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ক্যান্সার।দুধে পুষ্টিগুণ কম থাকায় এটি মানবদেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে অপুষ্টির কারণ হতে পারে।
ভেজাল গোখাদ্য কিনে পশুর অসুস্থতা বা মৃত্যু হলে খামারিরা মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। দুধ ও মাংসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় তাদের আয় কমে যায়, যা তাদের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পশুপালন দেশের একটি গুর“ত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। ভেজাল খাদ্যের কারণে এই খাতের উৎপাদন কমে গেলে তা সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এই ভেজাল গোখাদ্যের ব্যবসা কেবল আইনের লঙ্ঘন নয়, এটি একটি সামাজিক অপরাধ যা মানুষ ও পশুর জীবন কেড়ে নিচ্ছে এবং সুস্থ ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ করছে
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাশ মুখে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও, প্রশ্ন ওঠে: শুধুমাত্র সতর্কতা কি এই অপরাধীদের রুখতে যথেষ্ট? যদি এই অসাধু চক্রকে দ্রুত এবং কঠোর হাতে দমন করা না যায়, তবে শৈলকুপার পশুপালন এবং জনস্বাস্থ্য উভয়ই এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কেবল কথায় সীমাবদ্ধ থাকে, নাকি এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।