চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় গত ৬ বছরে হাতির আক্রমণে ১৯ জনের মুত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত শনিবার রাত ২টার দিকে কর্ণফুলীর বড় উঠানের শাহমীরপুর জমাদারপাড়া এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণ করে। এতে ওই এলাকার মোহাম্মদ ইব্রাহীমের তিন মাসের ছেলে মো. আরমান জাওয়াদ মারা যায়। এসময় হাতির আক্রমণে শিশুটির মা খজিমা বেগম (৩০) গুরুতর আহত হন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে ওইদিন সকাল ৬টা থেকে কেইপিজেড গেট এলাকায় নিহত শিশুর লাশ নিয়ে পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ফলে সড়কটির উভয় পাশে প্রায় দীর্ঘ আট কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এলাকা থেকে বন্য হাতি সরানোর দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা। ওইদিন কর্ণফুলী উপজেলার ভূমি কমিশনার রয়া ত্রিপুরা, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য, কর্ণফুলী থানার ওসি মোহাম্মদ শরীফ ও ওসি তদন্ত সাফিউল ইসলামের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের আলোচনা হয়। চারদিনের মধ্যে দাবি পূরণের আশ্বাসে সড়ক থেকে উঠে যান বিক্ষোভকারীরা।
৫ দিন পরও দাবি পূরণ না হওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার আবারও সড়ক অবরোধ করে স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা সকাল ৬টা থেকে প্রায় ১২টা পর্যন্ত পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এসময় হাজারো মানুষ বিক্ষোভ শুরু করেন দৌলতপুর কেইপিজেড গেট, আনোয়ারা টানেল সড়ক, চাতুরী চৌমুহনী, বড় উঠান ও মিয়ারহাট এলাকায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন হাজার হাজার যাত্রীর। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট।
এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আসেন সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ। এসময় কর্ণফুলী উপজেলা সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে বিক্ষোভকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বেঠকে বসেন নগর পুলিশের (কর্ণফুলী জোন) সহকারী কমিশনার জামাল উদ্দিন চৌধুরী, এসি ল্যান্ড কর্ণফুলী রয়া ত্রিপুরা, সেনাবাহিনীর সিইউ, ক্যাম্প কমান্ডার, বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ, ওসি কর্ণফুলী মোহাম্মদ শরীফ এবং বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপুরণ দেওয়া ও বন্য হাতি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিক্ষোকারীরা বলছে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হলে ঈদের পরে তারা আবারও আন্দোলনে নামবেন।
জানতে চাইলে ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, চারটি বন্য হাতির মধ্যে এখন তিনটি রয়েছে। একটি চলে গেছে। বাকি তিনটি হাতি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। হাতিগুলোর বিচরণের দিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। ওপারে (বাঁশখালী) গেলেই যেন আর আসতে না পারে সে ব্যবস্থা করা হবে। হাতিগুলোকে বিরক্ত করা যাবে না। বিরক্ত করলে তারা মানুষের ওপর আক্রমণ করে। তারা খাবারের সন্ধানে বের হয়। খাবার খেয়ে নিরাপদ আবাসস্থলে যায়। ফসল, ঘরবাড়ি ও মানুষের ক্ষতি করলে ক্ষতি পুরণ দেওয়া হয়। বিগত ছয় বছরে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ক্ষতি পুরণ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
গত বছরের ২২ অক্টোবরে বড় উঠান ইউনিয়নের দক্ষিণ শাহমীরপুর এলাকায় হাতির আক্রমণে মো. আকবর (৪২) নামের ওই ব্যক্তি মারা যান। ১১ সেপ্টেম্বর রাতে বড় উঠান ইউনিয়নের দৌলতপুরে হাতির আক্রমণে মোহাম্মদ সৈয়দ ওরফে লুতু মিয়া (৫৫) নামের এক কৃষক নিহত হন। তারপর ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকায় মো. কাশেম ওরফে দুলাল (৬০) এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের খোশাল তালুকদার বাড়ি এলাকায় রেহানা বেগম (৩৮) হাতির আক্রমণে মারা যান। সেপ্টেম্বর মাসে হাতির আক্রমণে তিনজন মারা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা বলছে, কেইপিজেড দেয়াং পাহাড় এলাকায় ২০১২-১৩ সাল থেকে হাতির আনাগোনা বেশি হয়। এর আগে হাতির আসা-যাওয়া ছিল। তবে তখন তুলনামূলক কম ছিল। ২০১৮ সালের শেষ দিকে ওই হাতির দলটি স্থায়ীভাবে কেইপিজেড এলাকায় বসবাস শুরু করে। কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান এবং আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ, বারখাইন, বটতলী ও বারশত; এই পাঁচ ইউনিয়নে গত ৬ বছর ধরে এসব বন্য হাতি চালাচ্ছে তাণ্ডব। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাতির আক্রমণে ওই এলাকায় মানুষের প্রথম মৃত্যু হয়।
হাতির আক্রমণে মো. আকবর মারা যান গত বছরের ২২ অক্টোবর। ২৪ অক্টোবর কেইপিজেড হাতি সুরক্ষা এবং দ্বন্দ্ব নিরসনে ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দেন বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম এবং সদস্য সচিব করা হয় ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজকে। সেই কমিটি প্রতিবেদন দিলেও বাস্তবে তা কাজে আসছে না।