দীর্ঘ দেড় যুগের বেসরকারি নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এখন থেকে পরিচালিত হবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেড (সিডিডিএল)-এর অধীনে। রোববার রাত ১২টা ১ মিনিটে এনসিটির দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নেয় ড্রাইডক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের একচ্ছত্র প্রভাবের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, ড্রাইডকের সঙ্গে ছয় মাসের চুক্তি অনুমোদন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ, যা সোমবার থেকে কার্যকর হয়েছে। সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডও আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ‘ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড’ (ডিপিএম) পদ্ধতিতে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ড্রাইডককে। পাঁচটি জেটি সমৃদ্ধ এ টার্মিনালে প্রতিদিন চারটি সমুদ্রগামী এবং একটি অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিচালিত হয়ে থাকে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই টার্মিনাল পরিচালনার কথা ভাবলেও, সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় নৌবাহিনীর অধীনস্থ কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে আইনগত জটিলতা এড়াতে সরাসরি নৌবাহিনী নয়, বরং তাদের নিয়ন্ত্রিত ড্রাই ডক লিমিটেডকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীদের প্রত্যাশা দ্রুত ও কম খরচে পণ্য ওঠানামা এবং ডেলিভারি নিশ্চিত করা। আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ এনসিটিতে প্রতি ঘণ্টায় ৩০টিরও বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব, যেখানে অন্যান্য টার্মিনালে এই সংখ্যা ১৭-১৮টি। বর্তমানে বছরে প্রায় ১২-১৩ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় এনসিটিতে।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এনসিটির এই দায়িত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডলিং নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। এখন নজর থাকবে ড্রাইডক ও নৌবাহিনীর অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপনায় নতুন মানদ- স্থাপনের দিকে।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্যক্রম শুরু করে সাইফ পাওয়ারটেক। তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে বন্দরের বিভিন্ন খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। একের পর এক চুক্তি নবায়ন এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতার মাধ্যমে টেন্ডার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি বন্দরের কার্যক্রমে আধিপত্য বজায় রাখে।
সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, এমপি নূর-ই-আলম চৌধুরী, এম এ লতিফ, সামশুল হক চৌধুরী ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ. জ. ম. নাছির উদ্দীনের সঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘকালীন কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে “বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল না দেওয়ার” দাবিতে একটি আন্দোলন সংগঠিত হয়। নৌপরিবহন বিষয়ক উপদেষ্টা (অব.) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তার হাতে এমন প্রমাণ রয়েছে যা দেখায় সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পরিকল্পিতভাবে অর্থ ব্যয় করে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘœ ঘটাতে চেয়েছিলেন।
এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেডের (সিডিডিএল) অধীনে এনসিটির দায়িত্ব হস্তান্তর বন্দর ব্যবস্থাপনায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এতে একদিকে সাইফ পাওয়ারটেকের একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠানের যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বন্দরের নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানোর আশা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এটি বন্দর ব্যবস্থাপনায় একটি গঠনমূলক ও সময়োপযোগী মোড় পরিবর্তন।
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনালগুলো হলো- চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)।