বাংলাদেশের চিকেন নেক খ্যাত ফেনী করিডোরের দিকে ভারতের লোলুপ দৃষ্টি দীর্ঘদিনের
একেএম আবদুর রহীম, ফেনী থেকে : ফেনী করিডোরকে বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ বলা হয়। দেশের আমদানি রপ্তানির ৯০ ভাগ এই করিডোর দিয়ে আনা নেয়া হয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে এই করিডোর। এজন্য ফেনী করি ডোরকে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন ও বলা হয়। ফেনী করিডোরের উপর ভারতের কুদৃষ্টি নতুন কোনো বিষয় নয়। ভারতের বিভিন্ন নেতা প্রায়ই এই করিডোর দখল করে বাংলাদেশ থেকে চট্টগ্রাম সহ বিভাগের আটটি জেলা বিচ্ছিন্ন করে দখল করার হুমকি দিয়ে থাকেন। ভারতীয় গণমাধ্যমও এই করিডোর দখল করার নিরবচ্ছিন্ন উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের এসব হুমকির কারণে দেশের ভিতর থেকে জোর দাবি উঠেছে ফেনীতে একটি সেনানিবাস ও বিমান ঘাঁটি স্থাপনের। ফেনীতে একটি সেনানিবাস থাকলে ভারত সহজে ফেনী করিডোর দখল করে ফেলতে পারবে এমন উদ্ভট চিন্তা করতে পারবে না। আর যদি ভারত এই করিডোরে হামলা চালায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। ফেনীর সবচেয়ে নিকটতম সেনাঘাঁটি হচ্ছে কুমিল্লা সেনানিবাস। সেখান থেকে ফেনীতে সেনাবাহিনী পৌঁছতে অনেক সময় প্রয়োজন। ফলে ভারত যদি এই করিডোরে হামলা চালায় সে হামলা তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ফেনী করিডরের নিরাপত্তা জোরদারে সেনাঘাঁটি নির্মাণ করা জরুরি ভিত্তিতে আবশ্যক। ফেনীতে সেনাঘাঁটি নির্মাণের প্রস্তাব বহু পুরনো। ২০০২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রথম ফেনীতে একটি সেনাঘাঁটি নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সে প্রস্তাব চাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে ভৌগোলিক দুর্বলতা এই ফেনী কোরিডর। অথচ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও এই কোরিডোর রক্ষায় তেমন কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এর অন্যতম কারণ ছিল অতীতের সরকারগুলোর ভারত তোষণ নীতি, ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, ভারতের পদলেহন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার অশুভ মানসিকতায় ফেনী করিডোরের নিরাপত্তা রক্ষার কোন ব্যবস্থা না করে উল্টো বাংলাদেশের একটি সংবেদনশীল এলাকায় ভারতকে নয় শত একর জমি বিনামূল্যে বরাদ্দ দিয়েছে বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। ফেনী নদীর উপর নির্মিত ব্রিজটি ভেঙ্গে দিলে বাংলাদেশ থেকে চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ইকোনমিক জোনের নামে ৯০০ একর জমি ভারতকে বরাদ্দ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল ফেনী করিডোরে ভারতের উপস্থিতি বাড়ানো। ২০১৫ সালে হাসিনা সরকার ভারতকে ইকোনমিক জোন তৈরির জন্য খুলনায় এভাবে বিনামূল্যে ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দিলেও তারা সেখানে ইকোনমিক জোন তৈরিতে অপারগতা প্রকাশ করে। বরং ভারত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফেনীতে ইকোনমিক জোন করতে সরকারকে চাপ দিতে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার তখন এর বিরোধিতা করে কিন্তু সরকার ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ইকোনমিক জোন করে সেখানে ভারতকে সম্পূর্ণ ফ্রিতে ৯০০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। ফেনী করিডোরের মত সংবেদনশীল এলাকায় ভারতকে ৯০০একর জমি বরাদ্দ দেয়ার অর্থ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভারতের হাতে তুলে দেয়া। দেশের নিরাপত্তাকে এরকম ঝুঁকির মুখে ফেলতে স্বৈরাচার সরকারের বিবেক এতটুকু বাধা দেয়নি। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার হীন মানসিকতার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এটা করেছে। এখানে যদি ভারত তাদের গুপ্তচর বাহিনীর আখড়া বানায় বা অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলে সরকারের কিছুই করা থাকবে না। ভারতের সাথে করা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে যে উক্ত নয় শত একর জমিতে ভারতের লাদাখ ও সিকিমে যেমন বাংলাদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ তেমনি বাংলাদেশীসহ অন্য কোন দেশের নাগরিকের প্রবেশাধীকার এখানে সংরক্ষিত করে রেখেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এটা যেন বাংলাদেশের বুকে একখণ্ড ভারত। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ভারতের কাছে জিম্মি করে রেখেছে। বাংলাদেশ ভারতকে ফেনী করিডোরে বিশাল ভূখণ্ড দিয়ে দিলেও ভারত তাদের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে চিকেন নেক ব্যবহার করে বাংলাদেশকে নেপাল ভুটান বা চীনের সাথে সড়ক পথে যোগাযোগ করতে দিতে রাজি নয়। বাংলাদেশের তেতুলিয়া থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার, বাংলাবান্ধা থেকে চীনের চাংথান শহরের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার এবং ভুটানের দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। বাংলাদেশকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চীন, ভুটান, নেপালের সাথে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না ভারত। ফেনী করিডোরের উপর আগ্রাসী ভারতের লোলুপ দৃষ্টি পড়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে ভারতের সেভেন সিস্টারে কোন সমুদ্র বন্দর নেই। ত্রিপুরা থেকে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। শুধুমাত্র ফেনী করিডোরের বাধার কারণে সমুদ্রপথে আমদানি রপ্তানি করতে পারছে না ভারত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ভারত ফেনী করিডোর দখলের চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে সময় পাকিস্তানী সেনাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ভারতীয়রা পিছে হঠছে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার পর এই যাবত কোন সরকার ফেনী করিডোরের নিরাপত্তা জোরদারের কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এই নিরাপত্তাহীনতায় শেষ পেরেক মেরেছে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার। তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলের নামে ভারতকে বিশাল ভূখণ্ড দিয়ে সমগ্র দেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ভারত সম্প্রতি আইন পাস করেছে যে, কোন বাংলাদেশী ভারতে কোন বিনিয়োগ করতে পারবে না অথচ ভারতীয়রা এদেশে বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে হাজার হাজার কোটি ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। ভারতের ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের সমুদ্রে পৌঁছতে একমাত্র বাধা ফেনী করিডোর বন্ধ করতে পারলে বা দখল করতে পারলে বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের একভাগ জায়গা হাতছাড়া হয়ে যাবে। বাংলাদেশের অখণ্ডতা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ফেনী করেডরের নিরাপত্তা জোরদার করার কোন বিকল্প নেই। খুনি হাসিনার পলায়নের পর জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদসহ প্রায় সকল রাজনৈতিক দল ফেনী করিডোরের নিরাপত্তা জোরদারে অনতিবিলম্বে এখানের সেনানিবাস স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ফেনী জেলা আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিসের শূরা সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী ভূঁইয়া সংগ্রামকে বলেন, ফেনী করিডোরের নিরাপত্তা রক্ষায় দ্রুত ফেনীতে সেনানিবাস স্থাপন করা আবশ্যক। তিনি বলেন, আমরা আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে সরকারের কাছে এই দাবী জানিয়ে আসছি। জামায়াতের ফেনী জেলা আমীর মাওলানা আবদুল হান্নান বলেন, বাংলাদেশের সকল অর্থনৈতিক অঞ্চল বিশেষ করে ফেনীর অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে ভারতকে বিতাড়িত করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের অখণ্ডতা ঝুঁকির মুখে থাকবে।