কাশ্মীরের সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভারত কি পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ তথা সর্বাত্মক (স্থল-নৌ-আকাশ পথে) যুদ্ধে জড়াতে পারবে? এর জবাবে ভাষ্যকারগণ বলছেন, বর্তমান সময়ে সেরকম অনুকূল পরিস্থিতি নেই ভারতের পক্ষে। কারণ, একদিকে প্রায় সব প্রতিবেশীই সম্পর্কের দিক দিয়ে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব বিরাজ করছে। অন্যদিকে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ভারতের অভ্যন্তরেও অশান্তি বিরাজ করছে। মূল প্রতিপক্ষ পাকিস্তানও ভারতের সঙ্গে সামরিক ভারসাম্যে অনেকটাই এগিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা বিশ্বে এক ইসরাইল ছাড়া ভারতের আর কোনো বন্ধু বা শুভাকাক্সক্ষী নেই। অন্যরা কেবলই বিজনেস পার্টনার। বিরাট জনসংখ্যার বৃহৎ বাজার ছাড়া ভারতের আদর্শগত কোনো সঙ্গী নেই। এছাড়া ভারতকে একসঙ্গে ৬/৭টি সীমান্তবর্তী দেশের সীমানা প্রহরা জোরদার করার মতো বিপুল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখতে হচ্ছে। যেটি সম্ভব হবে না বলেই মনে করেন তারা। অপরদিকে পাকিস্তানের পৃষ্ঠদেশে সেরকম চাপ বর্তমান নেই।
সীমান্ত-প্রতিরক্ষা নিয়ে চাপ : ভারতকে একই সঙ্গে অনেকগুলো সীমান্ত-প্রতিরক্ষা সামাল দিতে হচ্ছে। এর মোট দৈর্ঘ সাড়ে ১৫ হাজার কিলোমিটার। ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এর পরেই রয়েছে চীন। অন্য সীমান্তবর্তী দেশগুলো হলো পাকিস্তান, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান। এছাড়া সমুদ্রসংলগ্ন নিকটবর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা এবং এর পরেই রয়েছে মালদ্বীপ। সীমান্তবর্তী না হলেও কাছাকাছি রয়েছে আফগানিস্তান। ভারতকে একসঙ্গে অনেকগুলো দেশের সীমান্তের প্রতিরক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাছাড়াও সেভেন সিস্টার্সের প্রতিও বিশেষ নজরদারি রাখতে হচ্ছে। মনিপুরের সংঘাত বিশেষ মাথাব্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পশ্চিম পাশজুড়ে এককভাবে ভারতের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত- যার দৈর্ঘ ৩ হাজার ৩২৩ কিলোমিটার। আর পূর্ব পাশে পাকিস্তানের সীমান্তে রয়েছে কেবল আফগানিস্তান ও ইরান। স্বল্প দৈর্ঘের সীমান্ত রয়েছে চীনের সঙ্গে। ফলে এই দিক থেকে পাকিস্তান নিরাপদ থাকতে পারে। একারণে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতকে পাঁচগুণ বেশি সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগে থাকতে হচ্ছে।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স: ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক বর্তমান অবস্থায় স্থিতিশীল নয়। এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর ও জুনাগড় নিয়ে বিবাদ সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই। বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ যেনো একেবারে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। চীনের সঙ্গে চলছে অরুণাচল ও লাদাখের মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদ। সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখ সীমান্তে কয়েক দফায় হালকা সংঘর্ষও হয়েছে। ভুটানের সঙ্গে চীনকে জড়িয়ে ‘ডোকলাম’ উপত্যাকায় সামরিক উত্তেজনা মাঝেমধ্যে মাথাচাড়া দেয়। এখানে চীনের সামরিক স্থাপনা নির্মাণের ফলে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর বিপন্ন বলে ভারতীয়দের উদ্বেগের সীমা নেই। নেপালের সাথেও আর মধুর সম্পর্ক নেই। ভারত সীমান্তসংলগ্ন মাধেসি ও তরাই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সাথে নেপালের প্রধান ধারার জনগোষ্ঠীর, পাহাড়ি-সমতলী স্বার্থবিরোধকে উসকে দেয়ার ফলে নেপালের সাথে মনমালিন্য চলে। আর বাংলাদেশের সাথে গত বছর চব্বিশের আগস্টের সরকার পরিবর্তনে নাখোশ হয় ভারত। কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি না থাকলেও কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অস্থিরতা অব্যাহত রয়েছে।
ভারতের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারকে নিয়েও স্বস্তিতে নেই ভারত। যেটুকু সীমান্ত মিয়ানমারের সঙ্গে রয়েছে তা সেভেন সিস্টার্সকেন্দ্রিক। তবে জান্তাবিরোধীরা যেভাবে শক্তি ও সাফল্য ক্ষয় করছে তাতে ভারত জান্তার উপর একতরফা ভরসা করে থাকতে পারছে না। এর মধ্যে স্বাধীন আরাকান গঠন নিয়েও অস্বস্তি রয়েছে ভারতের। ভারতের সমুদ্র সীমানার নিকটবর্তী দেশ শ্রীলংকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অতীতে উজ্জ্বল থাকলেও বিভিন্ন সময়ে তাতে ঘাত-অভিঘাতের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। সম্প্রতি এই সম্পর্কেও বড়ো রকম ফাটলের সূচনা হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। দেশটির চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতায় ভারত তা কীভাবে সামাল দেবে তা যেনো বুঝে উঠতে পারছে না। শ্রীলংকায় ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনও ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভারত মহাসাগরের আরেক সমুদ্র-প্রতিবেশী মালদ্বীপ নিয়েও স্বস্তিতে নেই ভারত। সেখান থেকে ভারতকে সৈন্য সরিয়ে নেয়াসহ বলতে গেলে ধাক্কা খেতে হয়েছে। ভারতের সরাসরি সীমান্তে অবস্থিত না হলেও আফগানিস্তানকে অনেকটাই ভারতের প্রতিবেশী তূল্য মনে করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের আফগানিস্তানে অবস্থানের দিনগুলোতে ভারত একেবারে নির্বিঘেœ সেখানে মৌচাক নির্মাণ করে মধু আহরণ করে চলে। কিন্তু ন্যাটোর বিদায়ের পর তাকেও পাততাড়ি গোটাতে হয়। পিছনে ফেলে আসতে হয় মধুভরা মৌচাক। সেই যন্ত্রণাও এখনো সইতে হচ্ছে ভারতকে।
সামরিক শক্তির ভারসাম্য : সাধারণভাবে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিজের আয়তন, জনসংখ্যা এবং আর্থ-সামরিক শক্তি দিয়ে বিচার করে একপ্রকার ‘অবজ্ঞা’ করার নীতি নিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই নীতিই তার জন্য বুমেরাং হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গেও এই অবজ্ঞার নীতি কাজে দিচ্ছে না। কেননা পাকিস্তানের সামরিক শক্তির আয়তন ভারতের চেয়ে কম হলেও তাদের পারমাণবিক সামর্থ্য এক্ষেত্রে অনেকটাই ভারসাম্য এনে দিয়েছে। এই পারমাণবিক বোমার সংখ্যাও ভারতের তুলনায় বেশি বলে জানা গেছে। ভারত যদি প্রথমে এই মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করে তাতে পাকিস্তানের একটি জনপদের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, পাল্টা পাকিস্তান যদি তা ব্যবহার করে তাহলে ভারতের ক্ষতি হবে কয়েকগুণ বেশি। কারণ একটি শহরে ভারতের জনসংখ্যার পরিমাণ পাকিস্তানের যেকোনো শহরের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। সে কারণে ‘সীমিত’ আকারের যুদ্ধ হলেও তাতে কারো বিজয়ী হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হবে না।
অভ্যন্তরে বিভাজন
শাসকদলের সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করার ফলে এই সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরেও জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সামাজিক অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ‘হিন্দুত্ববাদী’ ঐক্য গড়তে গিয়ে অন্যদেরকে অসন্তোষের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তির অভিভাবকত্ব কেড়ে নেয়ায় এবং মসজিদ ভাঙ্গা ও নিপীড়নের শিকার হওয়ায় বিপুল সংখ্যক মুসলিম নাগরিক মোদী সরকারের উপর ক্ষুব্ধ। এছাড়া রয়েছে ‘খালিস্তানপন্থি’ শিখদের সাম্প্রতিক হুমকি-ধামকিমূলক বক্তব্য প্রচার। আরো আছে মাওবাদী গেরিলাদের উৎপাত, আছে সেভেন সিস্টারর্স-এর বেশির ভাগ রাজ্যে অশান্ত পরিস্থিতি।
সর্বাত্মক যুদ্ধ হবে না
১৯৭১ সালের পর ভারতের আরো কয়েক দফায় পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশংকা তৈরি হয়। কিন্তু কোনো সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ায়নি দুই পক্ষ। এবারের কাশ্মীরের হামলার পর যেভাবে ভারত ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে মনে হয়েছিল সেটি হয়নি। বরং ভারত উল্টো পরিস্থিতিতে পড়েছে। একদিকে আন্তর্জাতিক মহলে যুদ্ধ শুরুর মতো পরিস্থিতি বাখ্যা করতে পারছে না। অন্যদিকে কাশ্মীরের এবারের ঘটনা ‘সাজানো’ ও ‘পাতানো’ বলে দেশের ভেতরেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানকে দোষারোপ করার নৈতিক অবস্থান হারিয়ে যােেচ্ছ। সবমিলিয়ে আরেকটি ‘সর্বাত্মক’ যুদ্ধে ভারত অবতীর্ণ হতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতিকে ভারতের জন্য শাঁখের করাত বলে মনে করছেন।