‘ভারি বৃষ্টির কারণে আমাগে বাড়ির মধ্যে হাটুর উপরে পানি জমে গেছে। রান্না ঘরের মধ্যেও পানি উঠছে রান্না বান্না করতে পারছি না। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সারাদিন ঘরের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। আমাদের বসত ঘরটা উচু সেজন্য বাড়িতে থাকতে পারছি, বাড়ির মধ্যে আমার ছেলে পানিতে মাছ ধরার জন্য জাল পেতেছে। আজকে দুপুরে রান্না করতে পারিনি।’ কথাগুলো বলেছিলেন খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার নাকসা গ্রামের মো. ইদ্রিস আলীর স্ত্রী আঞ্জুয়ারা খাতুন। এ সময় পাশবর্তী এক মহিলা বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে ১ সপ্তাহ মতো আমরা বারান্দার নিচে নামতে পারিনি। আমাদের বাড়ি ঘর কবর স্থানে সব জায়গায় হাটু বেশি পানি জমে আছে। কাচা ঘর গুলোর সব দেয়াল ভেঙে যাচ্ছে পানি বের হওয়ার কোন পথ নেই। কেউ একটু আমাদের খোঁজ নিচ্ছে না।’ একই গ্রামের বাসিন্দা জিনারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বাড়ির মধ্যে হাঁটুর বেশি পানি। বাড়ি থেকে রাস্তা পর্যন্ত বের হতে গেলে বুক সমান পানি পাড়ি দিয়ে রাস্তায় উঠতে হচ্ছে। বাড়িতে রান্না বান্না সব বন্ধ আছে। বাজার থেকে শুকনো খাবার কিনে তাই রাতে খাবো।

একই গ্রামের বাসিন্দা ইসমাইল মোড়ল , ইলিয়াস, জাহাঙ্গীর, আব্দুল করিম সহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, বর্ষা মওসুমে ভারি বৃষ্টি হলে আমাদের এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। খাওয়া দাওয়া রান্না, বান্না, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে খুব কষ্টে থাকতে হয়। যদি একটা লোক মারা যায় তাহলে মাটি দেওয়ার মতো জায়গা নেই। আমরা গ্রামবাসী একসাথে হয়ে ইউএনও স্যারের কাছে প্রায় ১ বছর আগে একটা লিখিত অভিযোগ করেছিলাম। তিনি কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, নাকসা গ্রামবাসী বর্ষা মওসুমে জলাবদ্ধতার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কারণ প্রধান সড়কের দুই পাশের সরকারি জমিতে যে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রয়েছে তা কতিপয় প্রভাবশালী, দুষ্ট প্রকৃতির লোকজনের অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে লোকমান সরদারের বাড়ি থেকে হামিদ সানার বাড়ির পর্যন্ত প্রধান সড়কের পাশে সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনার ফলে বর্ষা মওসুমে নাকসা গ্রামের অধিকাংশ ঘর বাড়ি বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকে। গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থতায় ভোগে। এই গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি আলিয়া মাদরাসা আটটি জামে মসজিদ এবং দুইটি হেফজ খানা রয়েছে। সেখানে শত শত শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত। বর্ষা মওসুমে এ সকল শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুবই কম। বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকা বাড়ি সমূহের শিক্ষার্থীরা প্রধান সড়কে এসে বিদ্যালয় যাতায়াত করতে পারে না। এই গ্রামের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পাঠদানে পিছিয়ে পড়ার কারণে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ার আশংকা থাকে। এরূপ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুলী বিশ্বাস বলেন, ঘটনাস্থলে নায়েবকে পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে ভারী বর্ষায় উপকূলীয় পাইকগাছা উপজেলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আর বেড়েছে জনদূর্ভোগ। উপজেলা কৃষি অফিস ও আদালত চত্বরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে। গত কয়েক দিনের মধ্যে কয়েকবার একটানা ভারী বর্ষণে পাইকগাছার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এ বছর বর্ষকালের শুরু আষাঢ় মাসের প্রথম থেকে একটানা গুড়ি গুড়ি, হালকা ও ভারি বৃষ্টি লেগে আছে। এতে আমন ধানের বীজ তলা, সবজি ক্ষেত, মৎস্য লীজ ঘের, নার্সারী, পুকুর, বাগান, রাস্তা ও বসতবাড়ি তলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

পাইকগাছার গদাইপুর, হরিঢালী, কপিলমুনি ও রাড়ুলী উঁচু এলাকা হলেও বাকী ৬টি ইউনিয়ন নিচু এলাকায় অবস্থিত। সামান্য বৃষ্টি হলে এ সকল এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তবে গত দিনের ভারী বর্ষণে উঁচু এলাকাও পানিতে তলিয়ে গেছে। পৌর বাজারের স্বর্ণ পট্টি, মাছ বাজারসহ বিভিন্ন রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলার বেশিরভাগ গ্রামীণ রাস্তাগুলি পানিতে তলিয়ে থাকে। বাড়ির উঠানে পানিতে তলিয়ে থাকায় সাধারণ মানুষ বিড়াম্বনায় পড়েছে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষরা কাজে যেতে না পারায় কর্মহীন হয়ে পড়ে আর্থিক অনাটনের মধ্যে পড়েছে।

উপজেলার সদর ইউনিয়ন গদাইপুরের কয়েকশ’ নার্সারী ক্ষেত পানিতে তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবজি ক্ষেত ও আমন ধান ঝড়ো হাওয়ায় ঝরে পড়ে পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েক দিনের একটানা বৃষ্টিতে মানুষের জনদূর্ভোগ বেড়েই চলেছে। পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এলাকাবাসির একই অভিযোগ, পৌরসভা ও বিভিন্ন ইউনিয়ানের পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি বের হতে পারছে না। তাছাড়া ব্যক্তি স্বার্থে কিছু মানুষ তার বাড়ির সামনের বা পাশের ড্রেন বন্ধ করে রাখায় পানি ঠিক মত বের না হতে পেরে বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এতে করে জলবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। পাইকগাছা মেইন সড়কের ঘোলাবাটি, সলুয়া, নতুন বাজার ও জিরো পযেন্ট এলাকার ভাঙ্গা রাস্তা আরো ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে ছোট ছোট ডোবায় পরিণত হয়েছে। যানবাহন ঝুকি নিয়ে চলাচল করছে। পাইকগাছা উপজেলা নার্সারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও নার্সারি ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, ভারী বৃষ্টিতে নার্সারীর বেড ডুবে লক্ষ লক্ষ মাতৃ চারা মরে গেছে। ফলে কোটি কোটি টাকার লোকসান হবে এ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। বৃষ্টি না কমলে আমারা চারা উৎপাদন করতে পারবোনা।

পৌরসভার কৃষক মোহাম্মদ আলী জানান, সবজি ও ধানের বিজ তলা পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়ির উঠান পর্যন্ত বৃষ্টির পানি জমে আছে। এ ব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. একরামুল হোসেন জানান, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে এলাকা প্লাবিত হয়ে আমন ধানের বীজ তলা তলিয়ে গেছে ও সবজি ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। আমাদের উপ-সহকারী কর্মকর্তারা ইউনিয়ানে কাজ করছেন। ভারি বৃষ্টির কারণে কৃষকরা ব্যপক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

পাইকগাছা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার সৈকত মল্লিক বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার পুকুর ও প্রায় পাঁচ হাজার ছোট বড় ঘের তলিয়ে গেছে। যদি আবার এখন ভারী বৃষ্টি না হয় তাহলে অতি দ্রুত পানি সরে যাবে। এতে কোটি টাকার মাছ চলে যাবে। এ ব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন বলেন, ভারী বর্ষণে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য নদীর স্লুইচ গেটগুলি উন্মুক্ত রাখাসহ বিভিন্ন পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলি পরিস্কার করতে টিমগুলি কাজ করছে।