মু . শফিকুল ইসলাম গোমস্তাপুর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে : আবহমানকাল ধরেই বাংলার ঘরে ঘরে বাহারি পিঠা তৈরি করাটাই ঐতিহ্য। একেক এলাকায় একেক রকমের ঐতিহ্যকে ধারণ করেই সারাবাংলাদেশে পিঠা বানানেরা ধুম পরে শীতকালে। তেমনি চাঁপাইনবাবগঞ্জেও শীতকাল এলে তিলের পিঠা বানানোর ঐতিহ্যও বহুকাল ধরে চলে এসেছে। তবে সময়ের পরিবর্তনে এই ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। একটা প্রজন্ম সেই পিঠা বানানোর দৃশ্য দেখছে না বলে, এরা মনে-ই করতে পারবে না যে, এই তিলের পিঠা চাঁপাই অঞ্চলের ঐতিহ্যের অংশ ছিল। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শীত মানেই শুধু কনকনে ঠাণ্ডা নয়; এক উৎসবের ঋতু। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে উঠা রোদ, উঠানে বসানো চুলা, আগুনে ভাজা পিঠা আর রান্নাঘরের ধোঁয়ার ভেতর মিশে থাকা তিলের সুবাস, সব মিলিয়ে শীতকাল এই অঞ্চলের আনন্দঘন অধ্যায়।
২০ বছর আগেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৃহস্ত পরিবারগুলোতে পিঠা-পুলির স্বাদে যে উপদানটি ছিল অবিচ্ছেদ্য- তাহলো তিল। এই অঞ্চলে তিলের আবাদ বেশি হওয়ায়; এই উপাদানকেই বেশি ব্যবহার করা হতো ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ পিঠায়।
বয়স্ক নারীরা জানিয়েছেন, তিলকুঁচি আর চিনি বা খেজুরের গুড় মিশিয়ে বানানো পিঠা ছিল ঘরে আসা অতিথির জন্য বিশেষ আপ্যায়নের প্রধান অনুষঙ্গ। বিশেষ করে জামাই বাড়ির লোকজনকে আদর আপ্যায়ন, নানির বাড়ি বেড়ানো, মেয়ে কিংবা শহর নগর থেকে বেড়াতে আসা ছেলের দিকের সম্পর্কের নাতি-নাতনিদের দাওয়াত দিয়ে পিঠা খাওয়ানোর রেওয়াজ এখনো কিছু কিছু স্থানে বিদ্যমান। এই পিঠা যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। সাথে সাথে ভালোবাসা ও আতিথিয়তার ঐতিহ্য।
কৃষিপণ্য হিসেবে বাংলাদেশে তিল চাষ হয়ে আসছে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে। তেলবীজ হিসেবে পরিচিত ফসলটি উত্তরাঞ্চলের বারিন্দ এলাকার মাটি ও পরিবেশের সাথে মানানসই ও সহজ এবং লাভজনক হওয়ায় এখানকার কৃষকও এই ফসল ফলাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
আমন ধান কাটার পর পতিত পড়ে থাকা জমিতে মুলত বোনা হতো তিল। এই অঞ্চলে তিল থেকে ঘরোয়া উপায়ে তেল উৎপাদন এবং তা পিঠাপুলিতে ব্যবহারের রীতি শুধু খাদ্যাভ্যাস নয় একটি সামাজিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল। শীতকালীন আড্ডা আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার ও পারিবারিক মিলনমেলায় এই তিলের পিঠা ছিল অপরিহার্য্য অনুষঙ্গ।
বলা হচ্ছে শীত এলেই গ্রামে গ্রামে বসতো পিঠা উৎসব। স্কুল মাঠ, হাট কিংবা পাড়ার খোলা জায়গায় বসতো পিঠার পসরা। পুলি পিঠা, তেলের পিঠা, পাটি সাপটা, মালপোয়া থেকে শুরু করে নানা স্বাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা। এই পিঠাপুলি কেবল শুধুই খাবার ছিল না, এটি ছিল মানুষের মিলন মেলা, আতিথেয়তা ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। মেহমান আসার খবর পেলে রাত জেগে কয়েক পরিবারে মেয়েরা মিলে এসব পিঠা বানাতো রাত জেগে। বিশেষ করে আমের রাজধানী চাঁপাই অঞ্চলে তিল ব্যবহৃত পিঠাগুলো পারিবারিক আবহের এই উৎসবে আলাদা মর্যাদা পেতে স্বাদে- পুষ্টিতে ভিন্নতা থাকায়।
নানা কারণে ভিন্নখাতে তিলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং তিল চাষে আগ্রহ কমে যাওয়া ছাড়াও আত্মীয় স্বজনের বাসায় মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বলে মনে করা হয়। সেই সাথে কৃষকরা নগদ আয়ের আশায় তিল চাষ থেকে সরে যায়। আরেকটি বিষয় হলো নতুন প্রজন্ম শহরমুখী হওয়া ছাড়াও বাজারে প্রস্তুত খাবারের সহজলভ্যতায় তিলের পিঠা এখন কালেভদ্রে দেখা যায়। শীতের উৎসবেও এখন দখল করে নিয়েছে আধুনিক মিষ্টান্ন।
আশার কথা হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় তিলের আবাদ বেড়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং তিলের ব্যবহার বিভিন্ন বেকারির খাবারে বেড়ে যাওয়ায়; কৃষকরা আবার তিল চাষের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তবে এই তিলের ব্যবহার পিঠা বাড়ছে না। কৃষকরা জানিয়েছেন, চাপাইয়ের কৃষি বিভাগ উচ্চ ফলনশীল জাতের তিল চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছে এবং তিল চাষ লাভজনক হওয়ায় চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে বিঘায় ৪-৫ মণ ফলন হয়। কৃষকরা বলছেন, তিল চাষ লাভজনক। এতে পরিচর্যা কম লাগে এবং ভালো দাম পাওয়া যায়। খরিফ ও রবি উভয় মৌসুমেই তিল চাষ করা যায় এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো এমন উঁচু বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটি এর জন্য বেশি উপযোগী। বিনা তিল-৩, বিনা তিল-৪, বারি তিল-৩ ও বারি তিল-৪ এর মতো উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার করা হচ্ছে।
এলাকার মানুষ বলছেন, উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে তিলের পিঠা পারিবারিক উষ্ঞতা, সামাজিক বন্ধন অটুট রাখা, আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখার প্রতীক। এই ঐহিত্য হারিয়ে যাওয়া একটি জীবন্ত সংস্কৃতির ক্ষয়। স্থানীয় উদ্যোগ, কৃষকদের প্রণোদনা এবং নানাভাবে আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসবগুলোর পুনরুজ্জীবন করা গেলে আবার ফিরবে তিলের পিঠার ঐতিহ্য।