বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ডাকে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হামলা, সহিংসতা, গুলি চালিয়ে হত্যা-হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন-নিপীড়ন, অপহরণ-গুমসহ বিভিন্ন অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ যাবত ৬৬৩টি ফৌজদারি মামলা রুজু করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫৩টি হত্যা মামলা। বাকি ২১৭টি মামলার অধিকাংশই হত্যাচেষ্টা, অপহরণ ও গুমের মামলা। এসব মামলা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে গুম, খুন ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তাধীন আরও চারটি মামলা। সর্বোচ্চ মামলা ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) এলাকায় হলেও খুলনা ও রাজশাহী মহানগরী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোন মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিটি মামলায় শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা, হুকুমদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুদকের মামলা রয়েছে ছয়টি। খবর পুলিশ সদর দফতর ও আদালত সূত্রের।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জমা পড়েছে আরও অর্ধশত অভিযোগ। এর মধ্যে পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি, মাইকেল চাকমা, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদসহ বিএনপির করা একাধিক অভিযোগ রয়েছে, যা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এসব অভিযোগের সত্যতা মিললে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তা ফৌজদারী মামলায় রূপান্তর করা হবে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করা হয় গত বছর ১৩ আগস্ট ঢাকার একটি আদালতে। আবু সাঈদ হত্যার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তা এ মামলার তদন্ত করছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে প্রথম মামলা হয় ১৩ আগস্ট। এর পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে মামলা হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধে গতকাল সোমবার শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-াদেশ দিয়েছেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথম সাজা। এর আগে আদালত অবমাননার অভিযোগে একটি মামলায় গত ২ জুলাই শেখ হাসিনাকে ৬ মাসের কারাদ- দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে মৃত্যুদ-ের রায় আসা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও একই অপরাধে মৃতুদ- পাওয়া সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ২৯৫টি এবং ৫ বছর দ-প্রাপ্ত সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ২৫৯টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। সবমিলে শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে ১২১৭ মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর কোনটিই এখনও বিচারের পর্যায়ে আসেনি। তবে কিছু মামলায় তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি, হত্যা, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন, অপহরণ ও গুমের ঘটনায় গত বছরের ৫ আগষ্টের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট মামলা ১৭৮৫টি মামলা রুজু হয়। এসব মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আলম মামুন, ওবায়দুল কাদের, সালমান এফ রহমান, অ্যাডভোকেট আনিসুল হকসহ আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। এছাড়া মামলার আসামি করা হয় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ঢাকার সাবেক ডিবি প্রধান হারুনর রশীদ, র‌্যাবের সাবেক ডিজি হারুন অর রশীদসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।

জানা গেছে, ১৭৮৫টি মামলায় মোট এজহারনামীয় আসামি ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৩৬ জন। এদের মধ্যে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৪ জন। ১৭৮৫টি মামলার মধ্যে ইতোমধ্যে তদন্ত শেষে আদালতে ৮১টি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা রয়েছে ২৫টি।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের তদন্তাধীন মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে সারাদেশে মেন্টর কমিটি কাজ করছে। পুলিশ সদর দপ্তরও মামলাগুলো তদন্ত তদারক করছে। কিছু মামলা তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। বাকিগুলো তদন্তাধীন।

সূত্রে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানায়। মামলাগুলোর তদন্ত তদারকি করতে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে একটি মেন্টর কমিটি কাজ করছে। ঢাকা মহানগরের পরই সর্বাধিক মামলা হয়েছে ঢাকা রেঞ্জের থানাগুলোয়। দায়ের হওয়া অধিকাংশ ফৌজদারি মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবু সায়েদ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে গত বছরের ১৩ আগষ্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা করা হয় মোহাম্মদপুর থানায়। এরপর একে একে মামলা হতে থাকে ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ মামলাতেই তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

সুত্র মতে, ঢাকার বাইরের মামলাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে অনেক স্থানীয় নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রেঞ্জভিত্তিক তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলার অগ্রগতি তদারক করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সব রেঞ্জের শতাধিক তদন্তকারীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাঁদের।

পুলিশ সদর দফতর, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালত সূত্রে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তথ্য থেকে জানা গেছে, গত বছরের আগষ্ট থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ৬শ ৬৩ টি মামলা। দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ৪শ ৫৩ টি হত্যা মামলা। এসব মামলার মধ্যে ঢাকা বিভাগে রুজু হয়েছে ৯৯ টি, চট্টগ্রামে ৩ টি, খুলনায় একটি, বরিশালে একটি, রাজশাহীতে ১১ টি, রংপুরে দুইটি, ঢাকা মহানগরীতে ৩২০ টি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৫ টি, গাজীপুর মহানগরীতে ৭ টি ও রংপুর মহানগরীতে ৪ টি। হত্যাচেষ্টা, অপহরনসহ অন্যান্য অভিযোগে মামলা হয়েছে ২ শত ১৭ টি। তারমধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬২ টি, খুলনা বিভাগে দুইটি, রাজশাহী বিভাগে ৫ টি, রংপুর বিভাগে ৪টি, ঢাকা মহানগরীতে ১৩৩ টি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৩ টি, বরিশাল মহানগরীতে একটি, গাজীপুর মহানগরীতে ৩টি, রংপুর মহানগরীতে একটি ও সিলেট মহানগরীতে ৩ টি। পরিসংখ্যান মতে, দেশের মহানগরীগুলোতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছে ৪শ ৮০ টি। এরমধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৩শ ৩৬ টি আর অন্যান্য ধারায় হয়েছে একশ ৪৪ টি মামলা। বাকি একশ ১৭ টি হত্যা মামলা হয়েছে মহানগরীর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায়।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবু সায়েদ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে প্রথম মামলা করা হয়। গত বছরের ১৩ আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে এস এম আমীর হামজা নামে এক ব্যক্তি এ মামলার আবেদন করেন। এরপরে বিচারক মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের জন্য থানাকে নির্দেশ দেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মিছিল, সমাবেশ করেছে। তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে। এতে বহু ছাত্র-জনতা নিহত ও আহত হন। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার ৪০ ফিট এলাকায় ছাত্র-জনতা শান্তপূর্ণ মিছিল সমাবেশ করছিল। সেখানেও পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। তখন রাস্তা পার হতে গিয়ে স্থানীয় মুদি দোকানদার আবু সায়েদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

দায়ের হওয়া উল্লেখযোগ্য মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা মো. রুমন নামের এক তরুণকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা রেকর্ড হয়। মামলার বাদী রুমনের বোন রুমিয়া আক্তার।

গুলশানে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর গুলশান এলাকায় আবুজর শেখকে (২৪) গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গুলশান থানায় এ মামলা রেকর্ড হয়েছে। মামলার বাদী আবুজর শেখের মা ছবি খাতুন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় প্রগতি সরণির বারিধারা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিল চলছিল। তখন মিছিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতারা গুলি করেন। এ সময় আবুজর শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এর ৯ দিনের মাথায় মারা যান তিনি।

বাড্ডায় মাদ্রাসা ছাত্রকে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর বাড্ডায় হাফেজ মাসুদুর রহমানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছরের ৯ নভেম্বর বাড্ডা থানায় করা ওই মামলায় সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, আনিসুল হককেও আসামি করা হয়। সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা : যাত্রাবাড়ীতে সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছরের ৭ নভেম্বর মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানায় রেকর্ড হয়েছে। মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, যাত্রাবাড়ীতে খবর সংগ্রহের সময় গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।