রাজশাহী মহানগরীতে তিন দশক ধরে বেড়ে চলেছে তাপমাত্রা। সবুজ এলাকা কমেছে ২৬ শতাংশ এবং জলাশয় কমেছে ৩ ভাগ। একটি গবেষণায় এই উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া যায়।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, রাজশাহী নগরীর শীতকালীন ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত তিন দশকে ধারাবাহিকভাবে এবং স্থানভেদে উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি শহরের পরিকল্পিত নগরায়ণ, তাপমাত্রার আরামদায়ক অবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি বাসযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এই গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে। এই গবেষণা কাজে রিমোট সেন্সিং এবং জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী নগরীতে শীতকালে ভূ-পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ২.৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যেখানে কিছু কিছু এলাকায় এই বৃদ্ধির হার ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। জাতিসংঘের একটি সংস্থা, ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এর গাইডলাইন অনুযায়ী, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রতি দশকে ০.২-০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়া উচিত নয়। সেই তুলনায় রাজশাহীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, মোট ২ দশমিক ৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ১৯৯০-২০০০ সালে ০.৬৩ ডিগ্রি, ২০০০-২০১০ সালে ০.৯৫ ডিগ্রি এবং ২০১০-২০২৩ সালে ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে।
‘সাস্টেইনেবিলিটি’ নামক একটি পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো শহরে সবুজায়ন এবং জলাশয় কমে যাওয়া, যা কংক্রিট এবং অন্যান্য অপরিবাহী পৃষ্ঠ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এই তিন দশকে নগরীর সবুজ এলাকা কমেছে ২৬ শতাংশ এবং জলাধার কমেছে ৩ শতাংশ। বিপরীতে নির্মিত অবকাঠামো বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। এ সময়ে নির্মিত অবকাঠামোর পরিমাণ ৯ দশমিক ৭৩ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ২২ দশমিক ৯৯ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে সবুজ এলাকা কমেছে ১২ দশমিক ৪৮ বর্গ কিলোমিটার এবং জলাশয় কমেছে ১ দশমিক ৪৪ বর্গ কিলোমিটার। সবুজ ও জলাধার কমে যাওয়ায় শহর তার উষ্ণতা মোকাবিলার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হারিয়েছে। শহরের বাসিন্দারাও এই পরিবর্তন অনুভব করছেন।
তাপমাত্রার হটস্পট বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শহরের কেন্দ্রীয়-উত্তর, কেন্দ্রীয়-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রার এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই এলাকাগুলোতে একসময় বাগান ও পুকুর ছিল, কিন্তু এখন ঘন নগরায়ণের কারণে প্রাকৃতিক শীতলতা কমে যাওয়ায় এলাকাগুলো তীব্র পরিবেশগত চাপ এবং তাপমাত্রাগত অস্বস্তির মুখোমুখি হচ্ছে। এছাড়াও এসব এলাকায় বায়ুর মান খারাপ হচ্ছে, বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে এবং ডেঙ্গুসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে গেছে বৃষ্টিপাতের হিসেবও। গত বছর আষাঢ় মাসে মাত্র এক দিন বৃষ্টি হয়েছিল। তার আগের বছর ২০২৩ সালে বৃষ্টি হয়েছিল মাত্র তিন দিন। ২০২২ সালে চার দিন, ২০২১ সালে ছয় দিন, তার আগের বছর ২০২০ সালে বৃষ্টি হয়েছে পাঁচ দিন। তবে এবারের মতো আষাঢ়ে এমন বৃষ্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কবে হয়েছে, তা কেউ মনে করতে পারেন না। এবারের বৃষ্টির রূপ একেবারেই আলাদা। আষাঢ়ের ২৬ দিনে ২৫ মিলিমিটারের ওপর বৃষ্টি হয়েছে মাত্র দুই দিন; কিন্তু প্রতিদিনই অল্প হলেও বৃষ্টি হয়েছে। এবার আষাঢ়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করে প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু এক দিনও ভারী বৃষ্টি হয়নি। এখন বৃষ্টির সেই চেহারা বদলে গেছে। তবে এবার আষাঢ়ের চেহারা একেবারেই ভিন্ন। মাসের প্রতিদিনই কমবেশি বৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু কাজে লাগার মতো বৃষ্টি হয়নি।
এদিকে পুকুর ভরাট করে গত দু’দশকে আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। তথ্যে জানা যায়, রাজশাহী মহানগরীতে ২০১৪ সালে প্রায় এক হাজার পুকুর ছিল। এর মধ্যে গত ৬ বছরে ৮০০ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ২০০ পুকুর। এগুলোও ভরাটের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন কাজের জন্য গাছ কেটে ফেলার ক্ষেত্রে চলছে বেপরোয়া মনোভাব। গত এক দশকে এরকম অসংখ্য বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
এবিষয়ে হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, গাছ কাটা হোক আর পুকুর ভরাট হোক- এগুলো হচ্ছে তথাকথিত উন্নয়নের নামে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে গাছ ও পুকুর উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। কিন্তু এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে কতটা সর্বনাশা তার কোনো অনুভূতি নেই সংশ্লিষ্টদের। তিনি এবিষয়ে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ চান।