মাছের বাজারে নতুন এক পেশার উদ্ভব হয়েছে বছর চারেক। আঁশ ছাড়িয়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে অর্ধশতাধিক নর-নারী। কাঁচা মাছের আঁশ শুকিয়ে তৈরি হচ্ছে রফতানি পণ্য। এ থেকে বছরে আয় হচ্ছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। আঁশ এক সময় উচ্ছি’ হিসেবে ডাস্টবিনে ঠাঁই পেত। এক সময়ের উচ্ছি’ এ পণ্যের এখন কদর বেড়েছে।
খুলনা মহানগরীর ময়লাপোতা সান্ধ্য বাজার, নতুন বাজার, বড় বাজার, মক্কি মসজিদের পাশে, শান্তিধাম মোড়, খালিশপুর বাজার, কেশবচন্দ্র কলেজ মোড়ে আঁশ ছাড়ানোর সাথে সংযুক্ত হয়েছে অর্ধ শতাধিক নারী-পুরুষ। এ সব পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। তাঁদের সন্তানরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে।
রফতানি ব্যুরো অফিস খুলনার দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত চীনে দুই লাখ ১০ হাজার ১৭৯ ডলার রফতনি হয়েছে। সাতটি সার্টিফিকেট অর্জন হয়েছে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান জানান, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ কেজি মাছের আঁশ রফতানি হয়েছে। যার মূল্য তিন কোটি ৪১ লাখ ৫২০ টাকা। এ পেশার সঙ্গে যুক্তরা আঁশগুলো সংরক্ষণ করেন।
আঁশ ছাড়ানো নতুন পেশাদার মো. রুস্তম আলীর অভিজ্ঞতা, আগে তারা এ পণ্য ফেলে দিতেন। তবে গত প্রায় দুই থেকে তিন বছর ধরে রেখে দেন। এরপর রোদে শুকিয়ে সেগুলো সংরক্ষণ করেন। চট্টগ্রাম থেকে আসা ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিনিধিরা এগুলো কিনে নেন। তারা প্রতি কেজি শুকনো আঁশ বিক্রি করেন ৫৫-৬০ টাকায়। বছর দুই আগে ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাইকাররা সেগুলো বিদেশে রফতানি করেন।
নতুন বাজার লঞ্চঘাট এলাকায় মাছের আঁশ ছাড়ানোর সাথে সংশ্লি’ ২০ বছর বয়সী মুন্না। ছাদে রোদে শুকাতে দিয়েছিলেন আঁশ। পাশের ছাদ থেকে দেখে মনে হচ্ছে সোনালি রোদে আলোর ঝলকানি। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে সাত কেজি সংগ্রহ হয়। সেগুলো শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। ১০-১১ মাস পরে আনুমানিক ১০-১২ মণ হলে ব্যাপারীরা প্রতিমণ ১২শ’ টাকা দরে কিনে নেন। প্রতিমাসে বাড়তি কিছু অর্থ আয় হয়।
পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে রোদে মাছের আঁশ নাড়া-চাড়া করছিলেন সোহাগ। বিদ্যালয়ের পাশেই বাসা সোহাগের। তিনি বলেন, ‘এগুলো ভিজা অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায় না, পোকা লাগে। এগুলো কেও কিনে নেন গাছের গোড়ায় দেওয়ার জন্য।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. শিকদার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে মাছের আঁশ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষত সারানো, হাড় জোড়া লাগানো, কোষের কাঠামো পুনর্গঠন, চোখের কর্নিয়া পুনর্জন্ম, বিদ্যুৎ দ্বারা রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পাদন, প্রসাধনী প্রস্তুতকরণ এবং নোংরা পানি শোধন। মাছের আঁশে প্রচুর প্রোটিন, মিনারেল ও জৈব উপাদান থাকায় এটি চিকিৎসা বিজ্ঞান, মাছ ও পোল্টির খাদ্যশিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ মাছের আঁশ অপচয় হচ্ছে। মাছের আঁশ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও রফতানির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাবলম্বী করা সম্ভব।’ এ জন্য মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি, যা এই শিল্পকে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা ও সম্প্ররসারণে সহায়তা করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি উদ্যোক্তারা মাছের আঁশ প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলে এর কার্যকর উপাদানগুলো সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারে, তাহলে বিদেশ থেকে আমদানির প্রয়োজন হবে না। বরং এ সব উপাদান দেশেই বিভিন্ন খাতে কাজে লাগানো যাবে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে অগ্রগতি আনবে এবং দেশীয় পণ্যের ভালো দাম পাওয়া সম্ভব হবে।’