পাইকগাছা সংবাদদাতা : দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা বাগেরহাট অঞ্চল গুলোতে শীত মানেই এক বিশেষ আনন্দের ঋতু। কুয়াশায় ঢাকা ভোর, শিশিরভেজা ঘাসের ওপর সূর্যের আলো যখন ঝলমল করে ওঠে, ঠিক তখন প্রকৃতি যেন নতুন আরেকটি জীবন ফিরে পায়। এই শীতের আগমন শুধু মানুষের পোশাক বা প্রকৃতির আবহে পরিবর্তন আনে না, সাথে নিয়ে আসে প্রকৃতির এক অপূর্ব সৌন্দর্য অতিথি পাখিদের আগমন। হাজার হাজার মাইল উড়ে তারা আসে দুর উত্তরের দেশ থেকে একটুখানি বিশ্রামের আশ্রয় খুঁজতে। এই পাখিরা আসে শান্তি ও উষ্ণআর টানে, আমাদের দেশের হাওর, বিল, নদীচর আর জলাভূমিকে প্রাণবন্ত করে তুলতে। তাদের আগমন যেন প্রকৃতির এক নিঃশব্দ উৎসব। তাদের কোনো সীমান্ত নেই, লাগে না কোন পাসপোর্ট। সাইবেরিয়া, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, চীন, নেপাল কিংবা হিমালয়ের তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসে আমাদের এই ছোট্ট দেশে। সেখানে যখন বরফে ঢেকে যায় মাঠ, নদী জমে যায়, খাদ্য ফুরিয়ে আসে, তখন এই পাখিরা দলবদ্ধ হয়ে উড়ে আসে শিকারিরা শিকার করতে ও পেতে থাকে রাতের বেলায় বিভিন্ন ধরনের পাখির ডাকের মিউজিক বাজিয়ে জালের ফাঁদ পেতে শিকার করে প্রশাসনের এক ধরনের অসাধু কিছু কর্মকর্তার কারণে পাখি শিকার বেড়ে গেছে পাখি বিলুপ্তি মানে পরিবেশের ভারসাম্য বিলুপ্ত হওয়া কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেই অতিথি পাখিরা নিরাপদ নয়। যে মানুষ একসময় তাদের কলরবে আনন্দ পেত, সেই মানুষই এখন তাদের সবচেয়ে বড় হুমকি। শীত এলেই শুরু হয় অবৈধ শিকার মৌসুম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে হাওর ও বিলের খাশে বসবাসকারী কিছু অসাধু ব্যক্তি পাখি ধরতে বসায় ফাঁদ, জাল, কমনও বন্দুক। তারা ধরো, মারে, বিক্রি করে। বাজারে বিক্রি হয় অতিথি হাঁসের মাংস, অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্টে ‘বিশেষ পদ’ হিসেবে তা পরিবেশন হয়। অথচ তারা জানে না, এটি কেবল আইনবিরোধী নয়, এটি নৈতিকতার বিরুদ্ধেও এক ভয়ংকর অপরাধ। অতিথি পাখি হত্যার মানে হলো প্রকৃতির প্রাণকেই হত্যা করা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একসময় অতিথি পাখির সমারোহ দেখা যেত। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, সুন্দরবন কিংবা নদীর চরে হাজার হাজার পাখির আনাগোনা ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। এখন সেই দৃশ্য অনেক জায়গায় বিলুপ্ত। নদী ও হাওরের জল দূষিত, অনেক জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। শিকারিদের ভয়, মানুষের লোভ, আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সব
মিলিয়ে তারা এখন বিপন্ন। এই বিপন্নতার জন্য শুধু শিকারি নয়, নায় আমাদের সবার। শহরায়নের নামে আমরা নদী দখল করছি, জলাভূমি শুকিয়ে ফেলছি, কৃষিজমিতে বিষ দিচ্ছি। এতে শুধু মাছ বা জলজ প্রাণ নয়, পাখির খাদ্যও নষ্ট হচ্ছে। তারা কোথায় যাবে? কোথায় আশ্রয় নেবে? মানুষ তার নিজের উন্নয়নের নামে প্রকৃতির প্রতিটি অংশকে ধাংস করছে, অথচ ভুলে যাচ্ছে এই প্রকৃতিই মানুষের জীবনের মূলভিত্তি। অতিথি পাখিদের বিলুপ্তি মানে শুধু এক প্রজাতির বিলু-স্তি নয়, এটি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। তারা প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কাজ করে, জলাশয়কে পরিশুদ্ধ রাখে। যদি তারা না থাকে, তাহলে বাড়বে পোকামাকড়, বাড়বে জল দূষন, কমবে জীববৈচিতা। আর জীববৈচিত্র্য কমে গেলে মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়ে উঠবে। এখন সময় এসেছে সচেতন হওয়ার। অতিথি পাখিদের বাঁচাতে হলে তাদের আশ্রয়স্থল বাঁচাতে হবে। জলাশয় ভরাট বন্ধ করতে হবে, নদী ও বিলের দূষণ রোধ করতে হবে, শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে কারন তারাই প্রকৃত রক্ষক। যেখানে অতিথি পাখি আসে, সেখানকার মানুষকে বোঝাতে হবে, এই পাখিরা তাদের বন্ধু, শত্রু নয়। তারা পর্যটন বাড়াতে পারে, জীবিকার নতুন উৎস হতে খারে। অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে আসে অতিথি হয়ে, তাই তাদের আতিথেয়তা নিশ্চিত করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। অতিথিকে হত্যা নয়, সুরক্ষা দিতে হয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে মানবতার প্রতি সম্মান জানানো। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, সেটি শুধু মানুষের নয়, গাছ, পাখি, প্রাণী, নদী সবাই মিলে এই পৃথিবীকে বাসাযোগ্য করে তুলেছে। তাই একে অপরের অস্তিত্বকে সম্মান জানাতে শিখতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও অতিথি পাখি সংরক্ষণের শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে। শিশুরা যদি পাখিকে ভালোবাসতে শেখে, তবে বড় হয়ে কেউ আর বন্দুক হাতে নেবে না। অতিথি পাখির নিরাপত্তা ও স্বাধীন চলাফেরা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমরা কেউ যেন তাদের শত্রু না হই, বরং হই তাদের বন্ধু। আমরা যেন এমন এক দেশ গড়ি, যেখানে মানুষ ও পাখি একসঙ্গে বাঁচতে পারে, যেখানে আকাশে আবার ভেসে বেড়াবে তাদের ডানার ছায়া। যতদিন আকাশে উড়বে পাখিরা, ততদিনই বেঁচে থাকবে মানুষ, প্রকৃতি, আর পৃথিবীর শান্তি।