গাজীপুর মহানগরের হায়দরাবাদ আখলাছ জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা রইস উদ্দিনের (৩৫) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এলাকায় তীব্র উত্তেজনা, জনমনে বিভ্রান্তি এবং সংঘর্ষ সৃষ্টির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া এই ইমামের মৃত্যুর পর একদিকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়াচ্ছে উসকানিমূলক গুজব, অন্যদিকে একাধিক ধর্মীয় সংগঠন প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) এক জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে।
গত ২৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১১টায় হায়দরাবাদ মসজিদের ইমাম রইস উদ্দিনকে এক কিশোরকে বলাৎকারের অভিযোগে স্থানীয়রা আটক করে গণপিটুনি দেয়। এরপর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হলে পরদিন ভোররাতে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মারা যান।
পূবাইল থানার ওসি শেখ আমিরুল ইসলাম জানান, ইমামের কক্ষ থেকে কনডম, যৌন উত্তেজক ওষুধ ও কোমল পানীয়র বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। ছয়জন বালকের জবানবন্দিতে বলাৎকারের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
তবে নিহতের স্ত্রী সাজেদা বেগম লিখিত অভিযোগে দাবি করেছেন, তার স্বামীকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। ভিডিও ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়ানো হয়। পুলিশের কাছে খবর দিতে চার ঘণ্টা দেরি করে আহত অবস্থায় কারাগারে পাঠানো হয়, যা পরবর্তীতে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পুলিশের অবস্থান ও সতর্কবার্তা
জিএমপি দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন বুধবার রাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, "ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করছে। থানা ঘেরাও, সড়ক অবরোধ, মিছিল—এসব দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পুলিশ সবদিক বিবেচনা করে নিরপেক্ষ তদন্ত করছে। গণপিটুনির ঘটনা প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা
এই ঘটনায় এলাকায় জনমত দ্বিধাবিভক্ত। অনেক স্থানীয় বাসিন্দা ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্য বললেও, ধর্মীয় সংগঠনগুলো একে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার পক্ষ থেকে বুধবার টঙ্গী ও গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, “মাওলানা রইস উদ্দিনকে ঢাকায় একটি সমাবেশে অংশগ্রহণের অপরাধে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুন্নি মুসলমানদের উপর বারবার নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনে রক্ত দেব, কিন্তু অপতৎপরতা আর মেনে নেব না।”
নাগরিক বিবৃতি ও মানবাধিকার প্রসঙ্গ
১০৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, "রইস উদ্দিনের মৃত্যু গণপিটুনি ও পুলিশ-কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলার ফল। এটি রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।"
কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার রফিকুল কাদের জানান, “রোববার সন্ধ্যায় রইস উদ্দিনকে কারাগারে আনা হয়। সোমবার ভোররাতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্ত শেষে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।”
একদিকে রয়েছে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ অভিযোগ, অন্যদিকে ইমামের মৃত্যুকে ঘিরে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সত্যাসত্য নির্ধারণ কঠিন হলেও, পরিস্থিতি যেন আইন হাতে তুলে না নেওয়া হয়, সেজন্য প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।